অপরাধ ডেস্কঃ
বঙ্গবন্ধুর হত্যার মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভূলুন্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছিল। ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক চক্র ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর ব্লুপ্রিন্ট রচনা করে কুচক্রীরা। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়। ৭১-এর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ এবং বাংলাদেশের অগ্রগতি স্তব্ধ করে দিয়ে উগ্রবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য এই কিলিং মিশন চালায় তারা।
পাকিস্তানের আইএসআই এর সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান ও পরবর্তীতে তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। জিয়া যেমন এই খুনিদের রক্ষার জন্য ইনডেমনিটি আইন করেছিল, তেমনি খালেদা জিয়াও খুনিদের জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন অবারিত ভালোবাসা। এমনকি গ্রেফতার হওয়া খুনিকে পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন জেল থেকে, মানবসম্পদ ব্যবসার নামে খুনিদের কোটি কোটি ডলার পাচারের সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষাকবচ: জিয়া-এরশাদ-খালেদা
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের পরামর্শে খুনিদের নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠায় স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক। ১২ জন খুনিকে দেওয়া হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরি। এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মাধ্যমে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফিকে রাজি করিয়ে সেখানে কয়েকজনের বিলাসবহুল জীবনের ব্যবস্থা করে জেনারেল জিয়া। লিবিয়ায় থেকে রশিদ-ফারুকরা বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো সেসময়। তবে পরবর্তীতে দেশে এসে সেনাবাহিনীতে আবারো অস্থিরতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে এরা। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার দায়ে জেনারেল জিয়া কয়েক হাজার নিরপরাধ সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করলেও ফারুক ও রশিদকে কিছু বলেনি। তাদের আবারো নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয় সে।
জিয়াউর রহমানের পর এইচ এম এরশাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। এরশাদও কাছে টেনে নেয় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের। ১৯৮৬ সালের এর সাজানো নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেয় ফারুককে। এসময় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ফ্রিডম পার্টি গঠন করে দেশজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দমনে এরশাদের পেটোয়া বাহিনী হয়ে কাজ করে রশিদ-ফারুকের এই ফ্রিডম পার্টি। এমনকি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসায় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য প্রকাশ্যে হামলা চালিয়েছিল তারা। পরবর্তীতে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর তার ছায়ায় দেশেই নিরাপদে ব্যবসা বাণিজ্য করতে থাকে ফারুক রহমান। এমনকি খালেদা জিয়া সঙ্গে তার সম্পর্ক এতোটাই মধুর ছিল যে, তারা তখন নিজেদের মালিকানায় একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। কিন্তু বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে চলে যাওয়ায় তা আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরেই চাকরিচ্যুত মেজর ডালিমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়ে চীনে পাঠায় জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে তাকে হংকং, লিবিয়া ও কেনিয়াতেও চাকরি করে সে। ১৯৮০ সালে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থান-চেষ্টায় জড়িত থাকার কারণে সে কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু তৎকালীন স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া তাকে আবারো সসন্মানে চাকরিতে বহাল করে। পরবর্তীতে এরশাদের সময় ডালিমকে আবারো প্রমোশন দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতেই রাখা হয়।
বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি খন্দকার আবদুর রশিদ খানও ১৯৭৫ সালে খুনি ফারুকের সঙ্গে লিবিয়াতে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। ১৯৯১ সালের পর থেকে খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশেই বিভিন্ন ব্যবসা করে অগাধ টাকার মালিক হয় সে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে খালেদা জিয়া তাকে কুমিল্লা থেকে এমপি বানিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বানানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জনরোষের মুখে সেই নাটকীয় নির্বাচন বাতিল হয়। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে দেশ থেকে পালিয়ে যায় রশিদ। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে হত্যাচেষ্টার দায়ে পুলিশ আটক করে খুনি রশিদের মেয়ে মেহনাজ রশিদও খুনি ডালিমের চোট ভাই স্বপনকে।
এসময় স্বীকারোক্তিতে রশিদের মেয়ে মেহনাজ রশিদ জানায়, তার বাবা খন্দকার আবদুর রশিদ নিরাপদে বেঁচে আছে। সবসময় তার পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য সে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ের বর্ণনা দিয়ে সে জানায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান অন্যান্য খুনিদের সঙ্গে তার বাবাকেও বিদেশে পাঠায়। তার বাবা আবদুর রশিদ লিবিয়াতে আশ্রয় নেয়। এরপর ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রশিদের অনুরোধে জিয়াউর রহমান তার স্ত্রী ও চার সন্তানকে (মেহনাজ রশিদসহ) থাইল্যান্ডে পাঠায়। সেখানে কয়েকমাস হোটেলে ছিল তারা। সেসময় জিয়াউর রহমান তার পরিবারের প্রতিদিনের হোটেল খরচ বাবদ ১০০ ডলার করে বরাদ্দ দিয়েছিল। এরপর দুবাই হয়ে তাদের লিবিয়াতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে জিয়াউর রহমান। এমনকি ঢাকার গুলশানে তাদের পরিবারের জন্য জিয়াউর রহমান একটি ডুপ্লেক্স বাড়িও উপহার দিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বাবার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং কখনো বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বাস্তবায়ন সম্ভব না বলে খালেদা জিয়া তাদের আশ্বস্ত করে রাজনীতি করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি সুলতান শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় সচিব হিসেবে পাঠানো হয়। জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনামলে সে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে আবারো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে অব্যাহতি দেয় এবং দেশে ফিরিয়ে আনে। এরপর গ্রেফতার করে পুলিশ।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বজলুল হুদাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরি দিয়ে পাকিস্তানে নিরাপদ পোস্টিং দেওয়া হয়। জিয়ার সময়জুড়ে সে বাংলাদেশের কূটনীতিক হিসেবে ইসলামাবাদ ও জেদ্দায় দায়িত্ব পালন করে। ১৯৮৮ সালে বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদাকে মেহেরপুরের সংসদ সদস্য বানায় স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়ার স্নেহধন্য হয় সে। খালেদা জিয়ার আমলে বজলুল হুদা প্রকাশ্যে বলে বেড়াতো: কোনোদিনই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে না। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় বুঝতে পেরে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে চুরির অভিযোগে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে গ্রেফতার হয় বজলুল হুদা। এরপর তাকে ব্যাংকক থেকে ফিরিয়ে আনে বাংলাদেশ সরকার।
খুনি আজিজ পাশাও জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় আর্জেন্টিনা, কেনিয়া, ইতালিতে দায়িত্ব পালন করে। এমনকি খালেদা জিয়ার একান্ত বিশ্বাসভাজন কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯১ সালের পর থেকে জিম্বাবুয়ের ডেপুটি হাই কমিশনার হিসেবে নিয়োজিত ছিল সে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার গঠন করার পর আজিজ পাশাকে পদচ্যুত করা হয়। ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতেই মারা যায় এই খুনি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত আবারো ক্ষমতায় আসার পর, মৃত আজিজ পাশার চাকরি ফিরিয়ে দেয় এবং তাকে মরণোত্তর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আর্থিক সুবিধা প্রদান করে।
১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমানের স্নেহধন্য হয়ে সৌদি আরবে পোস্টিং পায় রাশেদ চৌধুরী। পরবর্তীতে এরশাদের সময়েও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের চাকরি বহাল থাকে। সর্বশেষ, ১৯৯১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারে থাকার সময়, খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় পলিটিক্যাল কাউন্সেলর হিসেবে জাপানের টোকিওতে কর্মরত ছিল সে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার গঠন করার পর তাকে অব্যাহতি দেয় বাংলাদেশ সরকার।
খুনি খায়রুজ্জামানের প্রতি যেনো আরো বেশি প্রসন্ন বিএনপি-জামায়াত জোট। ১৯৭৫ সালে মিসরে পোস্টিং দেওয়া হয় তাকে। এরপর থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে ক্রমাগত প্রমোশন হয় তার। এমনকি মালয়েশিয়ার হাই কমিশনার পর্যন্ত বানানো হয় তাকে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সময় দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই কর্মকর্তা। ১৯৯৬ সালে ফিলিপাইনের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত থাকা অবস্থায় দেশে সরকার বদল হয়। আওয়ামী লীগ তাকে জেল হত্যা মামলার আসামি হিসেবে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় এবং জেলে ঢুকায়। কিন্তু ২০০১ সালে আবারো বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর তাকে জেল থেকে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে এবং মুক্তি দিয়ে চাকরি ফিরিয়ে দেয়। খালেদা জিয়ার নির্দেশে এই খুনিকে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় প্রমোশন দেয় এবং মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠায়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোটের মেয়াদ শেষ হলে সে পালিয়ে যায়। আর কখনো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেনি সে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকে বানচাল করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে বিএনপি-জামায়াত
সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে সমর্থন ও সাহস নিয়ে খন্দকার মোশতাক প্রথমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা হবে না বলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। এরপর জিয়াউর রহমান সেই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে খুনিদের বিচারের সব পথ স্থায়ীভাবে রুদ্ধ করে। এই ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়াও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। এমনকি তাদের সংসদ সদস্য করেছেন, বছরের পর বছর ধরে প্রমোশন দিয়ে অর্থ-বিত্তের মালিক বানিয়েছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্যেও একাধিকবার চেষ্টা করেছে এই খুনিরা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের চলমান প্রক্রিয়াকেও থামিয়ে রাখা হয়েছিল। এমনকি গ্রেফতার হওয়া খুনিকে ছেড়ে দিয়ে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানোর কলঙ্কজনক নজিরও গড়েছেন খালেদা জিয়া।
আমরা সবাই জানি যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে খন্দকার মোশতাক। এরপরেই সামরিক শাসন জারি করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয় সে। এরপর জিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থন নিয়ে জারি করা হয় ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’, যা ইতিহাসে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বলে পরিচিত। ৭ নভেম্বরের পর নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করে দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। তারপর বঙ্গবন্ধুৃর খুনিদের পরিবারকে বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসন ও খুনিদের পদোন্নতি দেয় সে।
এসবের মধ্যেই, ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে সেনাপ্রধান জিয়া। এরপর ১৯৭৯ সালে এক সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে প্রবেশ করে, সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী এনে, এই কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’কে আইনে পরিণত করে সংবিধানকে কলুষিত করে। এরমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং জাতীয় চার নেতা হত্যার যাবতীয় অপরাধকে বৈধতা প্রদান করে সে। অর্থাৎ শিশু ও নারীসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতার কুখ্যাত খুনিদের বিচার করা যাবে না বলে ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে মন্ত্রণালয় গঠন করে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে দেশজুড়ে বিষোদগার শুরু করা হয়। অস্ত্রের মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে ফেলার সর্বোচ্চা অপচেষ্টা চালানো হয় স্বৈরশাসক জিয়ার নেতৃত্বে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর দেশ স্বৈরশাসকদের অধীনে থাকে। এসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুন্ঠিত করে দেশজুড়ে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটে। বিকৃত করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। এমনকি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দায়মুক্তি এবং রাষ্ট্রদূতের মতো সন্মানজনক চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে বিচারহীনতার নোংরা সংস্কৃতি চালু করা হয়। মুছে ফলা হয় আইনের শাসন। স্বৈরাচার ও উগ্রবাদীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। পরিত্রাণের রাস্তা থাকে তারা। গণমানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৮১ সালে নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর তার হাত ধরেই ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
এরপরেই ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিদের বিচারের আওতায় আনতে সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। এরপর গ্রেফতার হয় কয়েকজন খুনি। বাকিরা আত্মগোপনে চলে যায়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। একই বছরের ১২ মার্চ আদালতে বিচার শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে আপিলের পর আদালত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।
কিন্তু জানলে অবাক হবেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এই বিচার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি আওয়ামী সরকারের সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চাকরিচ্যুত কয়েকজন খুনিকে আবারো প্রমোশন দিয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন খালেদা জিয়া। জেল থেকে মুক্তি দিয়ে খুনি খায়রুজ্জামানকে সরাসরি মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি। এমনকি আওয়ামী লীগের সময়ে জিম্বাবুয়েতে থাকা অবস্থায় চাকরিচ্যুত ও পরবর্তীতে সেখানেই মারা যাওয়া আরেক খুনি আজিজ পাশাকে মরণোত্তর প্রমোশন দেওয়ার অবিশ্বাস্য নজির গড়া হয়েছে খালেদা জিয়ার সরাসরি নির্দেশে।
১৯৯১ সালেও খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকার সময় খুনি রাশেদ চৌধুরী ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরি দেন। খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় এসময় খুনি ফারুক-রশিদ-বজলুল হুদারা ফ্রিডম পার্টির নামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে দেশে, বিএনপি-জামায়াতের সহায়তায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা।
তবে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ফলে বিএনপি-জামায়াতের নির্দেশে ২০০১ সাল থেকে থেমে থাকা বিচারপ্রক্রিয়া আবারো শুরু হয়। উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে ১২ আসামির ফাঁসির রায় বহাল থাকে। ২০১০ সালে খুনিদের মধ্যে পাঁচ জনকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এরপর ২০২০ সালে আরো এক জন দণ্ডিত খুনিকে গ্রেফতার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। একজন বিদেশে মারা গেছে। বাকি পাঁচ জন ফাঁসির আসামি আত্মগাপন করে বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। তাদের খুঁজে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সরকার।