পবিত্র আশুরার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি

প্রকাশিত: ৪:৩২ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২২, ২০২০

অপরাধ ডেস্কঃ
হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। ‘মহররম’ শব্দের অর্থ সম্মানিত। এ সম্পর্কে পবিত্র কালামে এরশাদ হয়েছে, ‘ইন্না ইদ্দাতাশ শুহুরি ইন্দাল্লাহিছনা আশরা শাহরা, ওয়া মিনহুম আরবাআতুন হুরুম।’ অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা বারো, এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৩৬)। এ চার মাসের বৈশিষ্ট্য হলো, যারা বিশেষভাবে এ মাসগুলোতে ইবাদত-বন্দেগি করবে, আল্লাহ তাআলা তাদের বাকি আট মাস ইবাদত করার তাওফিক দান করবেন এবং যারা এ চার মাস নিজেকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবে, তাদের জন্য বাকি আট মাস যাবতীয় পাপকাজ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হবে।
হাদিস শরিফে চান্দ্রবর্ষের বারো মাসের মধ্যে মহররমকেই ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত সূরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতাংশে ‘আরবায়াতুন হুরুম’ অর্থাৎ ‘অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস’ বলতে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব—এই চার মাসকেই বোঝানো হয়েছে।
মহররম মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। এই দিনটি সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনের বিশেষ তাৎপর্য হলো, এই দিনেই পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ও অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
এই দিনেই সৃষ্টি করা হয় আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে, এই দিনেই তাঁকে বেহেশতে প্রেরণ করা হয়, এই দিনেই তাঁকে বেহেশত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয় এবং এই দিনেই তাঁদের উভয়কে (আদম-হাওয়া) আরাফাতের ময়দানে একত্র করা হয় ও তাঁদের ভুল-ত্রুটি মার্জনা করা হয়। অধিকন্তু এই দিনেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
এই দিনেই মুসলিম জাহানের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আল্লাহ তাআলা অশেষ মেহেরবানিতে অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি দেন, যখন নমরুদ বাহিনী তাঁকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে।
এই দিনেই হজরত মুসা কালিমুল্লাহ (আ.) নীল নদ পার হয়ে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পান এবং ফেরাউন দলবলসহ নীল নদে ডুবে মারা যায়।
এই দিনেই দীর্ঘ সময় ধরে প্রবল বন্যার পর ‘আদমে সানি’ বা ‘দ্বিতীয় আদম’ উপাধিতে ভূষিত হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করে এবং তিনি ও তাঁর অনুসারী ইমানদার ব্যক্তিরা বেঁচে যান। পক্ষান্তরে যারা তাঁর প্রতি ইমান আনেনি, তারা সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
এই দিনেই ছাহেবে হুত নামে অভিহিত হজরত ইউনুস (আ.) রাতের অন্ধকারে, পানির গভীরে ও মাছের পেটে—এই তিন স্তরের অন্ধকার থেকে মুক্তি পান।
এই দিনেই হজরত আইউব (আ.) সুদীর্ঘ ১৮ বছর রোগভোগের পর পূর্ণ সুস্থতা লাভ করেছিলেন। তিনি এমন সুস্থতা লাভ করেছিলেন যে তাঁকে দেখে তাঁর স্ত্রীও চিনতে পারেননি। এটা হচ্ছে মহান আল্লাহর মহা অনুগ্রহের ফলমাত্র এবং নবীদের অন্যতম হজরত আইউব (আ.)-এর কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ।
এই দিনেই হজরত ঈসা মাসিহ (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং এই দিনে ত্রিতত্ত্ববাদীদের রোষানল থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহর অশেষ কুদরতে তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়, যা পবিত্র কোরআনে সূরা আলে ইমরানের ৫৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
এই দিনেই হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর সঙ্গে তুর পাহাড়ে গিয়ে কথা বলেন এবং ইবরানি ভাষায় নাজিলকৃত প্রসিদ্ধ কিতাব তাওরাতপ্রাপ্ত হন।
এই দিনেই হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর অতি স্নেহের সন্তান, পরে মিসরের সম্রাটের স্বপ্নের তাবির বা ব্যাখ্যাকার হজরত ইউসুফ (আ.)-কে বহুকাল পরে ফিরে পান এবং তাঁর সন্তান হারানো বেদনার অবসান হয়।
এই দিনেই রাসুলে আরাবি নবীকুল শিরোমণি, ইমামুল হারামাইন, সাইয়্যদুস সাকালাইন, শাফিউল উমাম, ছাহেবে কাউসার, ছাহেবে কোরআন, হাদিউল উমাম, ইমামুল মুরসালিন জনাবে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম ওহিপ্রাপ্ত হন।
এই দিনেই হজরত সোলায়মান (আ.) সিংহাসন লাভ করেন। যাতে করে প্রতিদিন তিনি সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে এক মাসের রাস্তা ভ্রমণ করতেন, যা পবিত্র কোরআনের সূরা সাবার ১২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
এই দিনেই আল্লাহ তাআলা এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে করিম (সা.) হিজরত করে মদিনায় আগমন করার পর দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখে। নবী (সা.) এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এই দিনে হজরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইল শক্রবাহিনী থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন, তাই এই দিনে হজরত মুসা (আ.) এর শুকরিয়া আদায়স্বরূপ রোজা রেখেছেন। তা শুনে রাসুলে পাক (সা.) বললেন, হজরত মুসা (আ.)-এর অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার; তাই এই দিনে তিনি রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার হুকুম দেন। কিন্তু কেবল আশুরার দিনে রোজা রাখলে বাহ্যিকভাবে ইহুদিদের অনুকরণ হয়ে যায়। তাই রাসুলে মাদানি (সা.) বলেন, তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিহার করো। অর্থাৎ আশুরার আগে বা পরে আরও এক দিন রোজা রাখো। অর্থাৎ মহররমের ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ এই দুই দিন রোজা রাখো।
উম্মুল মুমিনিন হজরত হাফসা (রা.) বলেন, রাসুলে পাক (সা.) চারটি কাজ কখনো ত্যাগ করেননি। (১) আশুরার রোজা, (২) জিলহজের প্রথম নয় দিনের রোজা, (৩) আইয়ামে বিযের রোজা তথা প্রতি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোজা, (৪) ফজর ওয়াক্তে ফরজের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ।
হজরত কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন, আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা এর অছিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (তিরমিজি)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ, যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের নামাজ অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।
এ দিবসে সঠিক ফজিলত অনুধাবন করে সঠিক ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর অশেষ রহমত বা করুণার আশায় মাগফিরাতের প্রত্যাশায়, এই দিনের মহান ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত, রাসুল (সা.) প্রদর্শিত পথে এগিয়ে চলার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়া উচিত।
পরিশেষে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আলিশান দরবারে দোয়া কামনা করি, তিনি যেন আমাদের পবিত্র আশুরার তাৎপর্য অনুধাবন করে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটানোর তাওফিক ইনায়েত করুন। আমিন।
হাফেজ মাওলানা আবদুর রহীম: সিনিয়র পেশ ইমাম ও খতিব, গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদ (আজাদ মসজিদ)।




error: Content is protected !!