আলী আজীম,মোংলা প্রতিনিধিঃ
শেখ ফজলুল হক মনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন-তা সকলের জানা। তাঁকে বহু বিশেষণে সংজ্ঞায়িত করার পূর্বে তাঁর উচ্চমার্গীয় দর্শন ও ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা সর্বাগ্রে বিশ্লেষণ করা বেশি প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
স্বাধীনতা পরবর্তী ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ ভাবনায় তিনি কাতর হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি সতর্ক করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সর্বজনের প্রতি বিশ্বাসের ভিত টলাতে না পেরে ‘বাংলার বাণী’তে (১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২) লিখেছিলেন –
“‘বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই একটি রাষ্ট্র। মানুষ এখানে দরিদ্র। মধ্যবিত্তের উচ্চাভিলাষ এখানে অপরিমিত, স্বাধীনতার শত্রুরা এখানে তৎপর, পুরাতন আমলারা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রে পুনর্বাসিত। সুতরাং সময় থাকতে রোগ ধরা না গেলে দাওয়াইটিও কেউ খুঁজবে না এবং একজন সংবাদপত্রসেবী হিসেবে সে দায়িত্ব আমাদেরই।’
এই উদ্ধৃতির আক্ষরিক বাস্তবতা আমরা ’৭৫ পরবর্তী কালে দেখেছি।
শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাংবাদিক, কলাম লেখক, ছোট গল্পকার, তাত্ত্বিক দার্শনিক ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দ্রষ্টা।
বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগম (শেখ মনির মা) স্বামীর চাকরিসূত্রে কলকাতায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধু কলকাতায় থাকা কালীন সময়ে অধিকাংশ সময় এই বোনের বাড়িতে থাকতেন।
কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর অভিভাবক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এই আছিয়া বেগম এবং তাঁর স্বামী।
সক্রিয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু সব সময় পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা পেতেন। বঙ্গবন্ধুর চার বোন – এক ভাই ছিলেন একই বোধের, পরম আস্থার।
শেখ ফজলুল হক মনি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগমের বড় ছেলে, বঙ্গবন্ধুর আদরের ভাগ্নে।
শেখ মনি’কে বঙ্গবন্ধু বোনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন। বোনকে তিনি বলেছিলেন – “বুঁজি তোমার মনিকে আমারে দাও, ও রাজনীতি করুক।”
শেখ আছিয়া বেগম বলেন- “তুমি রাজনীতি করো তাতেই আমরা পুরো পরিবার উৎকন্ঠায় থাকি।”
বঙ্গবন্ধু – “বুঁজি রাজনীতিতে আমার তো কেউ ছিলো না, মনি’র তো আমি আছি।”
এরপর বোন আর তাঁকে না করতে পারেন নাই।
মাত্র ৩৫ বছর বয়সের ক্ষণজন্মা শেখ মনি ছিলেন- মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান, দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, কবি ও ছোট গল্পকার।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাগ্নেকে রক্ষা করতে পারেন নাই। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মনি তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শেখ আরজু মনিসহ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলেন।
১৪ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর বোন – শেখ ফজলুল হক মনির মা রাত বারোটা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছিলেন।
গল্প করেছেন ভাই ও ভাই পত্নীর সাথে। একান্তে সময় দিয়েছেন নিষ্পাপ রাসেলসহ সবার সাথে।
শেখ আছিয়া বেগম জানতেন না সেই রাতে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, ছোট ভাই শেখ নাসের, ছেলে, ছেলের বউ, ভাতিজাদের হারাবেন।
মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সবাইকে হারিয়ে তিনি পাথর হয়ে গেলেন।
পরবর্তীতে শেখ আছিয়া বেগমের সীমাহীন কষ্ট ও আতঙ্কের মাধ্যমে দীর্ঘ পথ চলা শুরু হয়।
শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি ও শহীদ আরজু মনির দুই ছেলে অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশ ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস হৃদয়বিদারক ১৫ আগস্টের কালো রাত স্বচক্ষে দেখেছেন।
বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো প্রতিদিন মৃত্যুর কবলে পড়ে আবার বেঁচেছেন।
ইতিহাসের জঘন্য সেই হত্যাকাণ্ড গা শিউরে উঠা ঘটনা শেখ পরশের জবানীতে –
“খুব ভোরে প্রচণ্ড ভাঙচুরের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি মা নেই পাশে। বিছানায় শুধু আমরা দুই ভাই। জানালা দিয়ে ঝড়ের মতো গোলাগুলি হচ্ছে। গুলিগুলো দেয়াল ফুটো করে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। সিঁড়িঘরে অনেক কান্নাকাটির আওয়াজ, হৈচৈ।
আমরা দুই ভাই ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়িঘরের দিকে গিয়ে দেখি বাবা-মা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়া। মা’র পা দুটো বাবার বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা। দাদির শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি যাছে, আর দাদি পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন; দেয়ালে কপাল ঠুকছেন।
এ অবস্থায় উনি আমার বড় চাচীকে বললেন, “ফাতু, আরজুর পা দুটি মণির বুকের ওপর থেকে সরাও।”
সেলিম কাকা আর চাচী বাবা-মা’র পাশে মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছেন। আর বাবা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নাই। মনে হচ্ছে উনি যেন শান্তির নিদ্রায় বিভোর। শুধু গলায় কণ্ঠমণির নিচে চামড়া উঠে যাওয়ার একটা চিহ্ন। বাবার শরীরের অন্য কোথাও কোনো ক্ষত আমার মনে নাই।
আমরা দুই ভাই কান্নাকাটি করছিলাম। মনে হয় আমরা ভয়েই কাঁদছিলাম; কারণ মৃত্যু কাকে বলে তখনো আমরা জানি না। মৃত্যুর পর যে মানুষকে আর পাওয়া যায় না, সেটাও আমার জানা ছিল না। মৃত্যুর সাথে ওই আমার প্রথম পরিচয়। একসাথে অনেকগুলো মৃত্যু।
মা’র মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সাথে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ।
মা চাচীকে বললেন, “ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।”
ওটাই বোধহয় মা’র শেষ কথা। এরপর কি হলো আমি জানি না। গুলির আওয়াজ অনেক বেড়ে যাচ্ছিল এবং কারা যেন এদিকে আবার আসছিল। আমার চাচী তখন আমাদের নিয়ে তার ড্রেসিংরুমে পালালেন। আমাদের মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিলেন যাতে গুলি না লাগে। গুলি মনে হয় বাথরুমের জানালা দিয়ে ড্রেসিংরুমেও ঢুকে যাচ্ছিল।
এরপর আর বাবা-মা’র সাথে আমাদের আর দেখা হয় নাই। শুনেছি সেলিম কাকা একটা গাড়িতে করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। আর মারুফ কাকা অন্য একটা গাড়িতে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এরপর সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুই ভাই, চাচী, দাদি, আর রেখা ফুফু এক কাপড়ে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে যাই। তখনো বুঝি নাই যে ওটাই নিজেদের বাসা থেকে আমাদের শেষ প্রস্থান। আর কখনো ঐ বাসায় ফিরতে পারব না।
আমার বয়স তখন পাঁচ বছর, আর আমার ভাই, তাপসের বয়স চার বছর। আমাদের বাসাটা ছিল ধানমন্ডি ১৩নং রোডে একটা কানাগলির রাস্তায়। বাসা থেকে বের হয়ে পাশেই ছিল একটা বিদেশি রাষ্ট্রদূত ভবন। আমরা সেখানেই আশ্রয় নেই। ওখান থেকে আমরা দেখতে পাই আমাদের বাসায় আর্মিদের আনাগোনা, লুটতরাজ।
এরপর শুরু হয় আমাদের ভবঘুরে জীবনযাপন; একেক দিন একেক বাসায়।
কোনো বাসায় দুই দিন, কোনো বাসায় চার দিন। আশ্রয়ার্থী হিসেবে এভাবেই চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কেন আমরা নিজের বাসায় ফেরত যেতে পারছি না। পরে দাদি-চাচীদের মাধ্যমে বুঝলাম যে আর্মিরা আমাদের খুঁজছিল।
কয়েকটা বাসায় আর্মিরা আমাদের খুঁজতেও এসেছিল। ভাগ্যিস আমরা সময়মতো সেই বাসা থেকে পালিয়ে অন্য বাসায় আশ্রয় নিয়েছি।
মাহুতটুলিতে মঞ্জু খালার বাসায় আমরা মনে হয় বেশ কিছুদিন ছিলাম। মঞ্জু খালা আমাদের পেয়ে অস্থির! আদর-যত্মেই ছিলাম, কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে ও বাসায়ও শান্তিতে থাকতে পারি নাই। চলে আসার সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্জু খালা ভীষণ কেঁদেছিলেন। তখনো জানতাম না ঐ কান্নার আড়ালে অন্তর্নিহিত কারণ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মঞ্জু খালাও ১৫ আগস্টে তার বাবা (আবদুর রব সেরনিয়াবাত), দুই বোন (আমার মা ও বেবি খালা), ভাই (আরিফ মামা) এবং চার বছরের ভাতিজাকে (সুকান্ত বাবু) হারিয়েছে। তারপর আবার আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাওয়াই তো ওনাদের জন্য প্রচণ্ড মানসিক চাপ ছিল।
আমার চাচীর আব্বা, মরহুম সুলতান আহমেদ চৌধুরীর বাসায়ও আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। এবং সেই বাসায় আর্মিরা রেইডও করেছিল। চাচীর বড়বোন, আনু খালার পাঁচ বছর বয়েসি সন্তান লিমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিল। পরে অনেক কসরত করে এবং ধস্তাধস্তি করে লিমাকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় ওর বাবা আজাদ আঙ্কেল। চাচীর মেজোভাই, বাচ্চু মামাকেও আর্মিরা তুলে নিয়ে যায়। বাচ্চু মামা সেলিম কাকা মারুফ কাকাদের সীমানা পার করে দিয়ে আসার পরেই তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় কর্নেল শাহরিয়ার। আর তাকে পাওয়া যায় নাই। এমনকি তার লাশটাও ওরা ফেরত দেয় নাই।
সবাই তখন সারাক্ষণ শুধু কাঁদত। কারও সন্তান হারানোর ব্যথা, কারও ভাই-বোন হারানোর কষ্ট, আর আমাদের বাবা-মা হারানোর অন্তহীন কান্না। তবে কেউ কারও সামনে কাঁদতে পারত না। আড়ালে গিয়ে বোবাকান্না কাঁদত। আমাদের সামনে সবাই কান্না আড়াল করে ফেলত। কারণ তখনো আমদের বলা হয় নাই যে আমাদের বাবা-মা আর নেই। এভাবেই জীবননাশের হুমকি আর ভয়ভীতিকে সঙ্গী করে আমাদের শোকাহত পরিবারের জীবনের গাড়ি চলতে থাকে।
সেলিম কাকা আর মারুফ কাকার জীবনে তখন চরম ঝুঁকি। মারুফ কাকা তখন খুনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কাদের সিদ্দিকী বাহিনীতে যোগ দিতে মেঘালয় চলে যান। সেলিম কাকাকে তো গুলিই করা হয়েছিল। অল্পের জন্য অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। শুনেছি খুনিরা যখন বাবাকে মারতে আসে, চাচী সেলিম কাকাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খবর দেন। সেলিম কাকা হুড়মুড় করে গিয়ে দেখে ওরা বন্দুক তাঁক করে আছে বাবার দিকে। সেলিম কাকা ওদের ধাক্কা দিলে ওরাও তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়িঘরের কোণায় ফেলে দেয়।
ঠিক তখনই ওরা গুলি করা শুরু করে। রুমের কোণায় এবং নিচে পড়েছিলেন বলে হয়তোবা গুলি তাঁর গায়ে লাগে নাই। ঐ মুহূর্তে মা তখন রুম থেকে বের হয়ে এসে বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। আমার মা মনে হয় বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তাই প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই মা বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে তিনি আমাদের কথাও ভাবেন নাই।
মা স্বামীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ রেখে গেছেন। হয়তোবা গুলি লাগার পরে তার আমাদের দুই ভাইয়ের কথা মনে হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার আর উপায় ছিল না।
১৫ আগস্টের পরে অনেকে আমাদের আশ্রয় দিতে ভয় পেতেন। আবার অনেকে জীবনের অনেক ঝুঁকি নিয়েও, আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সবার কথা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না বলে আমি দুঃখিত। তবে তখন আমদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইত না। কয়েক মাস পরে অনেক কষ্টে রেবা ফুফু (মেজোফুফু) আরামবাগে আমাদের জন্য একটা বাসা ভাড়া নেয়। ঐ বাসায় আমরা কয়েক মাস থাকি।”
উল্লেখ্য, শেখ মনির বেঁচে যাওয়া দুই ছেলে, শেখ ফজলে শামস পরশ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ এর চেয়ারম্যান ও শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র।
শোকাবহ ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ফজলুল হক মনির ছেলে তাপস বলেন, “অন্যদের বাবা-মায়ের কত স্মৃতি। আমারও তো ইচ্ছে করে অন্যদের মতো বাবা-মায়ের স্মৃতিচারণ করতে।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ তাপস আরো বলেন – ‘১৫ আগস্ট ১৯৭৫
তখনও আমার বয়স চার বছর পূর্ণ হয়নি’!
সারাদিন মা-এর সাথে লেগে থাকতাম। তাঁর পিছনে পিছনে। একটু চোখের আড়াল হতে দিতাম না। মা বাথরুমে গেলেও বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, আর দরজা ধাক্কাতাম কখন মা বেরিয়ে আসবে..
আমার মা শামসুন্নেছা আরজু মনি। স্বামীকে বাঁচাতে ঢাল হয়ে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঘাতকের নির্মম বুলেট নিয়েছেন নিজের বুকে ও পেটে। পারেননি তবুও স্বামীকে বাঁচাতে। অন্তঃস্বত্ত্বা অবস্থাতেই উৎসর্গ করেছেন তাঁর প্রাণ।
রেখে গেছেন দুই অবুঝ সন্তান- পরশ ও তাপস।
মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সময়ে…
দুই সন্তানের কথা মনে করে নীরবে ফেলেছেন চোখের পানি।
শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের মুহুর্তে পাশে বসা দেবর শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে শুধু বলে গেছেন: সেলিম ভাই, – ‘আমার পরশ-তাপসকে দেইখেন!’
দেবর শেখ ফজলুল করিম সেলিম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন ভাবীর সেই শেষ অনুরোধ।
বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে লালন-পালন করেছেন বড় ভাই শেখ ফজলুল হক মনি’র দুই পুত্র সন্তান পরশ ও তাপসকে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
মায়ের দু’টি গান খুব প্রিয় ছিল এবং দুটি গানই
আমাদের ঘুম পাড়ানোর সময় মা গাইতেন:
০১। পরশ/তাপস সোনা বলি শোন
থাকবে না আর দুঃখ কোন
মানুষ যদি হতে পারো..
০২। ও তোতা পাখিরে, শিকল খুলে উড়িয়ে দিব
আমার মা’কে যদি এনে দিস..
সবাই বলে ওই আকাশে….!
আমার বড় চাচী ফাতেমা সেলিম আমাদের এই দু’টি গান গেয়ে শুনাতেন এবং ঘুম পাড়াতেন। মা এর সব গল্প বলতেন।
দাদা, নানী, খালা ও ফুফুদের কাছ থেকেও
মায়ের সব গল্প শুনেছি।
শুনেছি গল্প (ফুফু) বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা থেকে; পিতা-মাতা হারানোর ব্যাথা যারা
রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুধাবন করে..
মা….!
মা এর স্মৃতি বলতে কয়েক সেকেন্ডের কম হবে
এমন একটি মুহূর্ত আবছা আবছা মনে পড়ে..
আমার মা মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার জন্য কিছুদিন নানা আবদুর রব সেরনিয়াবাত-এর বাসায় গিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।
সেই সময়ের কোন একদিন মা পড়ছিল, আর আমি আরিফ মামার সাথে খেলছিলাম। আরিফ মামা আমাকে ধরতে আসছিল। আর আমি মা এর কাছে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। এ রকম একটি মুহূর্তে আরিফ মামা
আমাকে ধরতে আসলো, আর আমি মা-এর কাছে দৌড়ে গেলাম।
…মা পড়ার টেবিলে মনোযোগ দিয়ে পড়া মুখস্ত করছিল! শুধু মনে পড়ে: আমি দৌড়ে মা’র চেয়ার ধরলাম আর মা হাসি মুখে আমার দিকে তাকালো।
আজও স্বপ্নের মতো লাগে আমার কাছে সেই মুহূর্তটা!
আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মূহুর্ত!
আমার সবচেয়ে বড় কস্ট-
মা এর আর কোন স্মৃতি নেই আমার কাছে।
আমি মনে করতে পারি না…
মা এর হাসি ভরা মুখ, তাঁর আদর আলিঙ্গন।
তাঁর ভালোবাসা, তাঁর রাগ, দুঃখ-কান্না।
মনে করতে পারি না-
– আমাকে গান গেয়ে ঘুম পাড়ানো।
– আমাকে গোসল করানো।
– আমাকে পড়তে বসানো।
– আমাকে কোলে নিয়ে চুল আঁচড়ানো।
চার বছরের সেই অবুঝ ছেলেটি আজও
খুঁজে ফিরছি মা এর স্মৃতি
মা এর হাসি, আদর, আলিঙ্গন, ভালবাসা।
অবুঝ বয়সেই বুঝতে পেরেছি-
আর পাব না!
মা’কে-ও না
তাঁর স্মৃতিও না
জেনেছি কঠিন সত্য; জীবনে চাইলেই
সব কিছু পাওয়া যায় না!
বুকের মধ্যে কষ্ট সহ্য করতে শিখেছি। কেঁদেছি নীরবে ডুকরে ডুকরে। জানতে দেইনি কখনোই কাউকে।
অনেকে বলে স্মৃতি তুমি বেদনার!
আমি বলি, স্মৃতি না থাকার বেদনা কত কষ্টের!
আমাকে একটু আমার মায়ের স্মৃতি দাও,
আমি তা-ই নিয়ে বেঁচে থাকি।”
শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সব থেকে প্রিয় রাজনৈতিক শিষ্য। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিলো সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় পরিচালিত। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ও শেখ মনির সম্পর্ক শুধু রক্তের বন্ধন দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। সেই সম্পর্ক ছিল অন্তরাত্মার।
ঘাতকরা জানত বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করতে হলে শেখ মনিকে আগে আঘাত করতে হবে।
বাংলাদেশের পললভূমিতে ‘ম্যাকিয়াভেলিয়ান প্রিন্স’ শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি ১৯৩৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শেখ নূরুল হক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নীপতি, মা শেখ আছিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম প্রধান গেরিলা বাহিনী মুজিব বাহিনী তাঁর নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত এবং পরিচালিত হয়। এ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
স্বাধীন – সার্বভৌম লাল সবুজের পতাকা খচিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এই মুজিব বাহিনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অনস্বীকার্য।
শেখ ফজলুল হক মনি ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে অনেক স্নেহ করতেন ও ভালবাসতেন। ছাত্র অবস্থাতেই শেখ মনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি ঢাকা নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ১৯৬০ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে ড. আলীম আল রাজী কলেজ থেকে তিনি আইনের উপর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাশ করেন।
শেখ ফজলুল হক মনি – নামটি শুনলে আমাদের সামনে একজন যুবনেতার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনের সোনালী সময় ছাত্র রাজনীতি, কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিক রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন।
মামা বঙ্গবন্ধু ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা, যুবনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতা। তাই ছোটবেলা থেকেই শেখ মনির আদর্শ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মনি বঙ্গবন্ধুকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাঁর চোখের ভাষা সহজেই বুঝতে পারতেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই শেখ মনি রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ কারণেই ভাগ্নেকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন।
ছাত্রজীবন থেকেই শেখ মনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি করা কালীন সময়ে তিনি ছিলেন সাধারণ ছাত্রদের প্রাণের স্পন্দন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে তিনি বারংবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন।
৬০ এর দশকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি শুরু করেন শেখ মনি। তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের কারণে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আইয়ুব – মোনায়েম খান তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে অন্যতম বড় শত্রু বিবেচনা করতেন।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের ফলে রাজনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসে। অর্থাৎ ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল এই তিন বছরের মধ্যে আড়াই বছরই প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আর এ সময় গোপনে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু রেখে ছাত্র ইউনিয়ন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তাই দলকে শক্তিশালী করতে গোপন রাজনীতির বিকল্প ছিল না।
শেখ মনির প্রধান কাজ হয়ে পড়ল ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জীবিত করা। যেহেতু রাজনীতি সংকটে, তাই শেখ মনি ছাত্রলীগকে ভিন্ন নামে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন।
শেখ ফজলুল হক মনি শিল্প ও সাহিত্য সঙ্ঘের আড়ালে ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে তিনি একটি বাহিনী গঠন করলেন এবং এই বাহিনীকে তিনি ছাত্রলীগ কর্মী আখ্যায়িত করতেন ; যাকে পরে সিরাজুল – রাজ্জাক সাহেবরা ‘নিউক্লিয়াস ‘ নাম দিয়েছিলেন। বাস্তবতা এই যে, শুরুটা শেখ মনির হাত দিয়ে হয়েছিল।
নিউক্লিয়াস ছিল পাঁচ বা দশ সদস্যের বিশেষ কর্মী দল, যারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা কামনা করে। সঙ্গত কারণে প্রায় সব ছাত্রলীগ কর্মীই এ মনোভাব পোষন করতেন। শেখ মনি বলতেন, তারা তাদেরই ছাত্রলীগে নিতেন ; যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং দেশের স্বাধীনতা কামনা করত।
শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন মেধাবী ও সাহসী। সেই সময়ের বক্র রাজনীতির মধ্যেও তিনি আইয়ুব খানের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ভাগ্নে হিসাবে নয়, ষাটের দশকের গোড়া থেকেই শেখ ফজলুল হক মনি নিজের মেধা ও অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা বলে দেশের ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন।
উত্তাল সেই আন্দোলন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা স্মৃতি কথায় বলেন, “মনে পড়ে ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মনি ভাই এই বাড়ি থেকে নির্দেশ নিয়ে যেতেন, পরামর্শ নিতেন। ১৯৬২ সালে আব্বা গ্রেফতার হন। তখনকার কথা মনে পড়ে খুব।”
ষাটের দশকের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি আন্দোলনে শেখ মনি ভূমিকা রেখেছেন। বাংলার কুলাঙ্গার মোনায়েম খানের হাত থেকে সার্টিফিকেট না নেয়ার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের নিকট থেকে সনদপত্র গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলন শুরু করেন।
যারা মোনায়েমের হাত থেকে উপাধিপত্র নেয়ার জন্য সভাস্থলে হাজির হয়েছিলেন, তারা উল্টো শেখ মনির নেতৃত্বে সভাস্থল বয়কট করেন এবং মোনায়েম খানকে প্রকাশ্যে বর্জন করেন; উপাধিপত্র না নিয়েই তারা ফিরে যান। এই আন্দোলন ব্যাপক রূপ ধারণ করে। প্রবল ছাত্র বিক্ষোভে সমাবর্তন পণ্ড হয়ে যায়। ক্ষুব্ধ সরকার প্রতিশোধ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করে। প্রায় দেড়শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে মোনায়েম খান ক্ষমতার দম্ভ দেখান।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি মামলায় সুপ্রীম কোর্টের রায়ে জয়লাভ করে ডিগ্রি ফিরে পান।
১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন।
শেখ মনির রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার পক্ষে হরতাল সফল করে তোলা। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী – আব্দুর রাজ্জাক। শেখ মনি ঢাকা – নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের পথসভা ও গেটসভা করতে বললেন এবং সমস্ত ঢাকাকে ১১ টা ভাগে ভাগ করে দায়িত্ব বন্টন করে দিলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে মুনিরুল ইসলাম, আলী আহমেদ (চুনকা), গোলাম মূর্শীদ (এস.সি.এ), আনসার সাহেব, চকবাজারের রিয়াজুদ্দিন ও নাজিরা বাজারের সুলতান সাহেব, ফজলুর রহমান, নিজাম সাহেব পুরাতন ঢাকার। নতুন ঢাকার কর্মীদের পরিচালনার জন্য জনাব আনোয়ার চৌধুরী, ময়েজউদ্দিন আহমেদ, জনাব নুরুল ইসলাম। মিসেস আমেনা বেগম ও গাজী গোলাম মোস্তফাকে সবকিছু দেখা শুনা করার দায়িত্ব দিলেন। ছাত্রদের ১১ টা গ্রুপের সার্বিক নেতৃত্বের ভার দিলেন জনাব মিজান চৌধুরীকে। তেজগাঁও, আদমজী পোস্তগোলাসহ শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করেছিলেন। এমনকি মানিক মিয়া বললেন, ইত্তেফাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তিনি পিছপা হবেন না। তিনি আরও আশ্বাস দিলেন, হরতালের কর্মসূচী যাতে করে সব কাগজে ছাপা হয় তার জন্য প্রভাব বিস্তার করবেন। বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে জানতে চেয়েছেন হরতালের প্রস্তুতি কতদূর কি হলো? গভীর রাতে পিছনের দেওয়াল টপকিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তার মামিকে সবকিছু বিস্তারিত জানিয়ে বললেন, রাতের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর নিকট খবর পৌঁছে দাও হরতাল হবেই।
তিনি যেহেতু ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করছিলেন; সেই সঙ্গে ঢাকা – নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের হরতালের পক্ষে তিনিই সংগঠিত করেছিলেন।
এই হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম হয়ত পিছিয়ে যেত।
১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং মোনায়েম খান শেখ মনিকে কারারুদ্ধ করেন। এ সময় বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়।
তিনি মুক্তি পান ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর।
দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য গোটা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন – সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রাখেন শেখ মনি। তিনি ছিলেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনমুখী কর্মসূচীর অন্যতম প্রণেতা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শেখ ফজলুল হক মনির উদ্যোগে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়। মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। আওয়ামী লীগ ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। প্রায় পাঁচ হাজার সদস্যের এ বাহিনীকে চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং এর নেতৃত্বে ছিল ১৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমান্ড। প্রথমদিকে সেক্টর কমান্ডার গন ভারতের ব্যারাকপুর, শিলিগুড়ি, আগরতলা ও মেঘালয় থেকে নিজ নিজ বাহিনী পরিচালনা করতেন। এ বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাক। শেখ ফজলুল হক মনি মুজিব বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেরাদুন পাহাড়ি এলাকায় এ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
ধারণা করা হয় মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সম্ভাব্য বিকল্প নেতৃত্বের প্রয়োজন মোকাবেলার জন্য মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মুজিব বাহিনী যুদ্ধ করেছে। তারা দখলদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন এবং ঢাকার আশেপাশে বেশ কিছু দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে। মুজিব বাহিনীর সদস্যগণ গেরিলা রণকৌশল বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ছিল এবং তারা ছিল তুলনামূলকভাবে উন্নত অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত।
বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুজিব বাহিনী গঠনের ধারণার উন্মেষ ঘটে বলে ধারণা করা হয়। সে সময় কতিপয় জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে এটি একটি একাডেমিক চিন্তা হিসেবে লালিত হত। মুজিব বাহিনীর অগ্রণী সংগঠকরাই এক সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন এবং তারাই ছিলেন ১৯৬৯ সালের এগারো দফা কর্মসূচীর প্রবক্তা। তাঁরা ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করেন, ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের পথে সার্বিক প্রস্তুতি সংগঠিত করেন। এ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি।
বঙ্গবন্ধু নিজেই বার বার বলেছেন, তিনি সমাজতন্ত্র তথা শোষণ বঞ্চনাহীন বাংলাদেশ দেখতে চান। একই সঙ্গে চান গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। ধর্মনিরপেক্ষতাও অপরিহার্য।
সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী শেখ মনি, সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক-বিমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ ভাগ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি। (স্মরণীয়-বরণীয়, ব্যক্তিত্ব, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়-পৃ:৪৬১)।
আগেই আমি উল্লেখ করেছি, শেখ মনি ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নিউক্লিয়াস বাহিনীর পরিকল্পক ছিলেন, তেমনি ১৯৭১ সালের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিব বাহিনী গঠনের অন্যতম প্রণেতা ছিলেন। এই ভূমিকা নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও আজ বুঝতে পারি, কেন শেখ মনি মুজিব বাহিনী গঠন করে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
সহজেই বিষয়টি অনুমান করা যায়, যদি সেই সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি। পাকিস্তানের শাসকরা তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, বিশেষ করে বাঙালিদের অধিকার বঞ্চিত করার জন্য ধর্মীয় বিভেদ উস্কে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের গণহত্যা তাদের কাছে ছিল ‘হিন্দুদের নির্মূল অভিযান’। আওয়ামী লীগ যেহেতু ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি অধিকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়, তাই আওয়ামী লীগকেও নিশ্চিহ্ন করতে হবে। এটাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় মুজিব বাহিনী গঠনের প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি।
মুজিব বাহিনী গঠনের পাশাপাশি শেখ মনি প্রকাশ করেন ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা। এ পত্রিকায় তিনি নিজে লিখতেন। থাকত রণাঙ্গণের খবর। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলার বাণী দৈনিক পত্রিকা হিসেবে তাঁর সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করে।
শেখ মনি ছিলেন যেমন মাঠের নেতা, তেমনি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা ধারণকারীও। প্রতিটি কথা ও কাজকে তিনি যুক্তি তর্কের মাধ্যমে জবাব দিতেন। আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে বলেন, দোহাই গাফফার ভাই গোস্বা করবেন না। আপনার নিবন্ধে আপনি বাংলার বাণীর হিম্মতের কথাটি তুলেছেন। এটা যদি কমপ্লিমেন্ট হয়ে থাকে তাহলে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আর যদি এটা খোঁচা মারার জন্য আপনি লিখে থাকেন তবে আমি বিনয়ের সাথে বলছি, আমার অবস্থা আপনার থেকে কোনক্রমেই সুবিধাজনক নয়। আপনার যোগ্যতা আছে, মেধা আছে, আছে অভিজ্ঞতা এবং পেশার ব্যাপারে সুনাম। একটা গেলে আর একটা পেয়ে যাবেন। আর ঐ একই একই কাজ করে আমাকে হারাতে হবে জাত। একবার হারালে আর ফিরে পাবো না। জানেনইতো আমার শত্রু সংখ্যা এদেশে আপনার চাইতে অনেক বেশি। (২৭ এপ্রিল, ১৯৭৩ বাংলার বাণী)
স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি আওয়ামী যুবলীগ গঠন করেন। এ সময়ে তাঁর বয়স ছিল ৩২ বছর। একই সময়ে পত্রিকার সম্পাদনার কাজ চালিয়ে যান। শ্রমিক আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট থাকেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য তিনি। দক্ষ সংগঠক, পরিশ্রমী, সাহসী ও উদ্যমী। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতার আশেপাশেও নেই। মন্ত্রী – এম.পি হতে পারতেন সহজেই। তিনি এ পথে চললেন না। শেখ মনি ছাত্র নেতা, শ্রমিক নেতা, যুবনেতা, মুক্তিযোদ্ধা সর্বোপরি মাঠের নেতা ছিলেন বলেই আত্মবিশ্বাস টা অনেক বেশী ছিল। এ কারণে এনায়েত উল্লাহ খানকে বলতে পেরেছেন, শেখ মনিরা জীবন বাজী রেখে মোনায়েমের কারাগারে অশেষ নির্যাতন আর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ভূঁইফোড় হিসেবে তাদের আবির্ভাব ঘটেনি। পরাজিত রাজনৈতিকদের গ্লানিও তাদের নেই। বাংলার বাণী বাংলাদেশে যদি আজ কোন সত্য আসন দখল করে থাকে তাহলে স্বাধীনতা সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য, কারো পৃষ্ঠপোষকতার জন্য নয়। ভুলে যান কেন আপনারা যখন চায়ের কারবার করেছেন আমি তখন যুদ্ধ করেছি। আপনি যখন মোনায়েমের গুন্ডার পার্টনারশীপ বাগিয়েছেন আমি তখন জেল খেটেছি। আপনি যখন তেল কোম্পানীর নকর ছিলেন, আমি তখন আন্দোলন চালিয়েছি। আর আপনি যখন হামিদুল হক চৌধুরীর হেরেমে সাংবাদিকতার তালিম নিচ্ছিলেন, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম শুরু করেছি।( ১৯৭৩ সালের ১ লা অক্টোবর বাংলার বাণী)
শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন বড় মাপের দার্শনিক। ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সমস্যা বের করেছিলেন। এ জন্যই তিনি বলেছিলেন – “রাজনৈতিক যুদ্ধে আমাদের পরাজিত করতে পারে এমন শক্তি বাংলাদেশে সহজেই জন্মাবে না। কিন্তু আমাদের সমাজনীতি, অর্থনীতি যদি ব্যর্থ হয়ে যায় তাহলে রাজনীতিটাই টিকবে না”।
টেকসই উন্নয়ন, এমনকি দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে যে প্রগাঢ় চিন্তা করতেন শেখ মনি – তাঁর এই উদ্ধৃতি দ্বারা সহজেই বোধগম্য হয়।
শেখ ফজলুল হক মনি একটি নাম, একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সাথে সাথে বাঙালি সংস্কৃতির উপাসকও। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চেয়েছিলেন স্বতন্ত্র একটি জগৎ গড়ে তুলতে। মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল যেন নিজস্বতা হারিয়ে না বসে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দৈনিক বাংলার বাণী, বাংলাদেশ টাইমস এবং বিনোদন পত্রিকা সাপ্তাহিক সিনেমার সম্পাদক ছিলেন তিনি। বাংলার বাণী যেমন মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল। আবার তাঁর প্রতিষ্ঠিত সুস্থ বিনোদন ধর্মী সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’ পত্রিকা বাঙালি সংস্কৃতির পরিশীলিত বুনিয়াদ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল।
শেখ মনি মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা গঠন করতে চেয়েছিলেন। শিশু কিশোরদের সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক বিকাশের লক্ষ্যে গড়ে তুলেন শাপলা কুঁড়ির আসরের মত প্রতিষ্ঠান।
শেখ মনি রচিত বেশ কিছু রাজনৈতিক উপন্যাস পাঠক সমাজে-সমৃদত হয়েছে। একটি উপন্যাস অবলম্বনে ‘অবাঞ্ছিতা’ নামে একটি জনপ্রিয় টেলিফিল্মও তৈরী হয়েছে। এছাড়া “গীতারায়” নামে গল্পগ্রন্থ বেশ জনপ্রিয় ছিল ।
শেখ ফজলুল হক মনি সংবাদ পত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সংবাদপত্রকে তিনি সমাজের দর্পণ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি নতুন পত্রিকা বের করার পিছনে দুটো যুক্তি দেখান (১) মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও সঠিক ইতিহাস সংবাদপত্রের মাধ্যমে তুলে না ধরলে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি সুযোগ পেলেই আঘাত হানবে এবং বিভ্রান্ত করবে দেশের সাধারণ মানুষকে। (২) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দোহায় দিয়ে সাংবাদিকের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার পথ চিরতরে বন্ধ হবে। তখনকার বাংলাদেশ পেক্ষাপটে তার দুটো যুক্তিই ছিলো অত্যন্ত সময় উপযোগী। (শেখ মনি – এম এ মুফাজ্জল, দৈনিক নিউ নেশন সম্পাদক)।
শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। তিনি এ পর্যন্ত যা সৃষ্টি করেছেন, সবই ছিল সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে তিনি সমসাময়িক প্রথিতযশা সাংবাদিকদের সাথে তুলনীয় ছিলেন। সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন,
“সংবাদপত্রের মালিক অনেকেই হতে পারেন। টাকা থাকলেই হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে যেমনটা হচ্ছে।কিন্তু সাংবাদিকতা পেশার ব্যাক গ্রাউন্ড নিয়ে যারা এসেছেন তাদের সংখ্যা খুব কম। মাওলানা আকরাম খাঁ, তফাজ্জল হসেন মানিক মিয়ার নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় । শেখ ফজলুল হক মনি তাদেরই মত উদ্যোক্তা ছিলেন। যেহেতু তিনি নিজে সাংবাদিকতা করে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছেন সেজন্য পেশার প্রতি ছিল তার ঐকান্তিক ভালবাসা।সংবাদপত্রকে তিনি শিল্প হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।” ( সাংবাদিক মনি ভাই,রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ,দৈনিক ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক)।
১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে সিরাজুল আলম খান, এম এ জলিল, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখ যখন উগ্র স্লোগান তুলে জাসদ গঠন করেন, বঙ্গবন্ধু সরকারকে দুর্বল করে ফেলার দেশী বিদেশী চক্রান্ত বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন তখন শেখ ফজলুল হক মনি তাদের অন্যতম টার্গেটে পরিণত হন। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে সাতজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এ খুনি চক্র গ্রেফতার হয়, বিচারে শাস্তি হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা জবরদখল করার পর জিয়াউর রহমান তাদের মুক্ত করে দেন। ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে শফিউল আলম প্রধানের মিথ্যা – কুৎসাপূর্ণ আক্রমণের প্রধান টার্গেট ছিলেন শেখ মনি।
এসব অনেক কারণে শেখ ফজলুল হক মনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী অস্থির যুবসমাজকে সৃজনশীল খাতে প্রবাহিত করতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, শােষণমুক্ত সমাজ অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচার, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা অর্থাৎ সকল ধর্মের মানুষের স্ব স্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার তথা জাতীয় চার মূলনীতিকে সামনে রেখে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমােচন, শিক্ষা সম্প্রসারণ, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তােলা এবং যুবসমাজের ন্যায্য অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১১ই নভেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের মধ্য থেকে স্বাধীনতা ও প্রগতিকামী যুবক ও যুব মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে একটি সুশৃংখল সংগঠন গড়ে তােলাই ছিল যুবলীগের মাধ্যমে তার উদ্দেশ্য।
একাত্তর পূর্ববর্তী আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর এক নম্বর সিপাহসালার। তেমনি একাত্তর পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় শোষণহীন সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’ও ফ্রন্ট ফাইটারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী যুব সমাজকে সৃজনশীল ও আদর্শ দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সে সময়ে কোন যুব সংগঠন ছিল না। অনেকটা সে কারণেই শেখ ফজলুল হক মনি শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন। ‘তলা বিহীন’ ঝুড়ি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দেশটি গড়ে তুলতে হলে তরুণদের ভূমিকা নিতে হবে – যুবলীগ গঠনের পেছনে এটাই ছিল প্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শও ছড়িয়ে দিতে হবে। সে সময়ে ‘মুজিববাদ’ বিশেষভাবে আলোচনায় ছিল। চার মূলনীতি ও মুজিববাদ যেন সমার্থক হয়ে উঠেছিল।
শেখ ফজলুল হক মনি বিশ্বাস করতেন, নতুন দেশ ও সমাজের চিন্তা করলে পরিকল্পিত কার্যপন্থার বিকল্প নেই। দক্ষ রাজনীতিবিদের একটু ভুলের কারণে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে নিক্ষিপ্ত হতে পারেন। সমসাময়িক বিশ্ব ও বৈশ্বিক রাজনীতির ওপর তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল। তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে’ পড়লেই বুঝা যায় বিশ্ব রাজনীতির সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার পেক্ষাপট। রুশ নেতা ক্রেনেস্কি জারের রাজাকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন। তার কাছ থেকেই ক্ষমতা কেড়ে নিলেন লেনিন। অথচ রাশিয়ায় লেনিনের চেয়ে ক্রেনেস্কির জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। তবুও যে সে সফল হলো তার প্রধান কারণ জারের শাসনের পর রাশিয়ার প্রশাসনযন্ত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল ক্রেনেস্কি নিজের লোক দিয়ে সেটা পূরণ করার ফুরসত পাননি বা সুযোগ নেননি। পক্ষান্তরে লেনিন সেই শূন্যতার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন নিজের সপক্ষে কমিউনিস্ট বিপ্লবের অনুকূলে। জার সরে গেল। সমাজবাদী (!) ক্রেনেস্কি বিতাড়িত হলো কিন্তু লেনিন বেঁচে রইল নতুন রাশিয়ার জন্মের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের পাতায়, বিশ্বের সমাজবাদী আন্দোলনের ধারা বিবরণীর ছত্রে ছত্রে তার নাম মুদ্রিত হলো, ‘মহান লেনিন’ হিসেবে।
শেখ মনি যেমন দার্শনিক ছিলেন, তেমনি ছিলেন ভবিষ্যৎ চিন্তক। তিনি অন্যান্য দেশের জাতীয় নেতাদের পতনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা ম্যাসেজ দিতে চেয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও কেন ইন্দোনেশিয়ার নেতা ড. সুকর্ণের পতন হলো। ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণো ক্ষমতায় এসেছিলেন বিপ্লবের পথ ধরে, যুদ্ধের পরে। তার দেশে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। সুকর্ণো কেবলমাত্র নব্য ইন্দোনেশিয়ার
জন্মদাতাই নন, তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের ইন্দোনেশীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে সব চাইতে উজ্জলতম নক্ষত্র, সব চাইতে চাকচিক্যময় মহাপুরুষ। ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে, জনতার মনে এবং বিশ্বের মনীষীদের দৃষ্টিতে তিনি এতটা শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন যে, অনেকে তার মধ্যে দৈবশক্তির, ঐশী প্রভাবের মাহাত্মা আরােপ করতে দ্বিধাবােধ করেননি। অথচ সেই সুকর্ণো আজ হারিয়ে গেলেন ইতিহাসের পাতা থেকে। বিশ্ব নাট্যমঞ্চের সব চাইতে দুর্দমনীয় প্রতিভাবান নায়ক একদিন মঞ্চের উপর দুমড়ে পড়লেন আকস্মিক, অভাবিত মূহুর্তে। হতবাক বিশ্ব, বিষ্ময়, বিমূঢ় ইন্দোনেশিয় জনগণ, অবাক বিষ্ময়ে দেখলো, সুকর্ণো আর তার দেশের কর্ণধার নন। যা কেউ কল্পনায়ও আনেনি, বা কেউ ভাবতে পারেনি, বাস্তবে তাই ঘটে গেল।
এই পতন বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও হতে পারে বলে সন্দেহ করেছিলেন তিনি। চিন্তা চেতনায় শেখ মনি সব সময় ছিলেন বিচক্ষণ।
বঙ্গবন্ধুকে, তাঁর দলকে দুর্বল করে ফেলতে হলে শেখ ফজলুল হক মনিকে দুর্বল করে ফেলতে হবে, এটি চক্রান্তকারীদের বুঝতে সমস্যা হয় নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দিনেই শেখ ফজলুল হক মনিকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তার কারণ সহজেই বোধগম্য। খুনি চক্র জানত – প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলার উপযুক্ত ব্যক্তি কে কে হতে পারে। শেখ ফজলুল হক মনির নামটি ছিল তাদের তালিকার একাবারে উপরের দিকে।
শেখ ফজলুল হক মনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ছিলেন। তিনি দেখেছিলেন প্রশাসনের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে আছে প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতা বিরোধীরা। মোনায়েমের আমলা দিয়ে মুজিবের শাসন চলতে পারে না। এই শিরোনামে শেখ মনি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলেন। যে লেখা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিলো প্রশাসনে। আমলারা একযোগে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ছুটে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগ নিয়ে। একজন মন্ত্রী টেলিফোন করে শেখ মনিকে বলেছিলেন, এ ধরনের লেখা প্রশাসনকে দুর্বল করবে। আমলারা আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। শেখ মনি বলেছিলেন, আজ হয়তো ক্ষমতায় থাকার জন্য আমার সমালোচনা করছেন কিন্তু মনে রাখবেন অল্প দিনের মধ্যেই বুঝতে পারবেন এই প্রশাসন কার। তখন অনেকেই শেখ মনিকে ভুল বুঝতেন। তারা মনে করতেন তিনি বোধকরি বিকল্প কোন শক্তির উন্মেষ ঘটাতে চাচ্ছেন। এই ধরনের অভিযোগ বঙ্গবন্ধুর কাছেও করা হতো। সিনিয়র মন্ত্রীরা নালিশ জানাতেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর আমলাদের অবস্থা কি হয়েছিল তা অনেকেরই জানা। খন্দকার মুশতাকের পেছনে ১৫ আগস্টের দিন জুম্মার নামাজ আদায়ের জন্য আমলাদের রীতিমত প্রতিযোগিতা ছিল। ( মনি ভাই, অকৃতজ্ঞ থেকে গেলাম- মতিউর রহমান চৌধুরী, মানব জমিনের সম্পাদক)
বাংলাদেশ জন্ম নেয় বিপুল খাদ্য ঘাটতি নিয়ে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য। শিল্প পণ্য আমদানি করতে দরকার ছিল প্রচুর অর্থ। জ্বালানী তেলের পুরোটাই আমদানি করতে হতো। কিন্তু তেলের দাম হু হু করে বাড়ছিল। স্বাধীনতা বিরোধীরা এসব প্রতিটি সমস্যার জন্য দায়ী করতে থাকে বঙ্গবন্ধুকে, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম গড়ে তোলা দল আওয়ামী লীগকে এবং বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশ ভারতকে। এমনকি যুবলীগ – ছাত্রলীগকে এই নতুন অপশক্তিকে মোকাবেলা করতে হয়। এ কারণে তাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। শেখ মনির যুবলীগ সকল সমস্যা মোকাবেলা করছিল। শেখ মনি সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন যুবকদের মধ্যে কোনভাবেই যেন ভুল মেসেজ না যায়।
শেখ ফজলুল হক মনির উপস্থাপন ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনি সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় সব কিছু তুলে ধরতেন। অজস্র লেখায় নজীর মেলে। ‘দূরবীনে দূরদর্শী’র লেখাগুলো পড়ে উপলব্ধি করা যায় শেখ মনির কলামে ছিল যথার্থ লেখকের ক্ষমতা। গদ্য শৈলীর প্রশ্নে বঙ্কিম চন্দ্রের মতো অনুপেক্ষণীয় গদ্যের বড়গুণ সরলতা এবং স্পষ্টতা। শেখ মনির কলামগুলোতে তার নিজস্ব মত সরল-সাবলীলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তার কথার সপক্ষে তথ্যের সন্নিবেশে কোনো ঘাটতি নেই। তিনি তাত্ত্বিকও ছিলেন। তত্ত্ব এসেছে অভিজ্ঞতা ও অধীত বিদ্যার উৎসমূল থেকে।
বারবারই তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবন সংশয়ের ব্যাপারটি ভাবছিলেন। তাই বলেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভাবনা-চিন্তা আমাদের সাধের বাংলাদেশটিকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন আমাদের মতো একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সমস্যা সঙ্কুল দেশের মানুষের জন্য অশেষ মূল্যবান। চীন, রাশিয়া, আমেরিকার জনগণের দৃষ্টিতে সেখানকার নেতাদের জীবনের চেয়েও মূল্যবান। মাও সে-তুং না থাকলে, নিক্সন না থাকলে বা ব্রেজনেভ, কোসিগিন না থাকলে সেখানে আজ আর সমস্যা হবে না। কারণ সেখানকার সমাজ আজ একটা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সড়ক নির্মাণ হয়ে গেছে। আমরা কেবল শুরু করেছি। আবর্জনা সাফ করে আমাদের যাত্রা পথ তৈরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই পথপ্রদর্শক কাণ্ডারি। খোদা না করেন, তাকে যদি আমরা হারাই, তাহলে বাংলার এই সাড়ে সাত কোটি দুঃখী মানুষের ভাগ্যে কি আছে! সুতরাং জাতীয় স্বার্থেই তার জীবনের জন্য যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার চেয়ে শতগুণ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল।’ (দূরবীনে দূরদর্শী- পৃ:১২৩)।
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ শুরু থেকেই সকল বাধা চূর্ণ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের জন্য যুবসমাজকে সংগঠিত করার দায়িত্ব পালনে যত্নবান ছিল। তবে তাদের কাজে বিঘ্ন আসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের তৎপরতায়। এ সংগঠনে যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের একটি অংশ আসে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের মধ্য থেকে। তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তবে এ দলে আরেক অংশ যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির মধ্য থেকে। ক্রমে তারাই হয়ে ওঠে পরাক্রমশালী। যে সকল আলবদর ও রাজাকার এবং তাদের দল জামায়াতে ইসলামী – মুসলিম লীগের নেতা কর্মী স্বাধীনতার পর পালিয়ে ছিল, তারা জাসদ গঠিত হওয়ার পর আশার আলো দেখতে পায়। ভোল পাল্টিয়ে জাসদে ঢুকে পড়তে থাকে। তারা সহিংস পথ অনুসরণ করতে থাকে। নানা অপপ্রচারে মেতে থাকে।
শেখ মনি সকল বিষয়ের নেতিবাচক দিক অনুধাবন করেছিলেন। তিনি হয়ত ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করেছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত তিনি কলমও ধরেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫-এ জাতীয় ঐক্যের রাজনৈতিদক দল বাকশাল গঠনের পর শেখ ফজলুল হক মনি বাকশালের অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাতীয় যুবলীগের দায়িত্ব দেয়া হয় তোফায়েল আহমদকে। নতুন ধারার আন্দোলন গড়ে তুলতে এ সংগঠন মনোযোগী হয়। কিন্তু ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের পর যুবলীগ-ছাত্রলীগ সহ সকল সংগঠনকে ফের মনোযোগ দিতে হয় মিছিল-সমাবেশ-হরতালের মত কর্মসূচির প্রতি। পরের দুই দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুবলীগ থাকে সামনের সারিতে।
শেখ ফজলুল হক মনি ব্যক্তি জীবনে ২ পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শেখ ফজলে সামস পরশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজীতে মাস্টার্স এবং পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও ইংরেজীতে ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি ইউনির্ভাসিটিতে ইংরেজীতে অধ্যাপনা করছেন। কনিষ্ঠ পুত্র শেখ ফজলে নূর তাপস ব্যারিস্টার ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, নিউ মার্কেট (ঢাকা-১২) এলাকা থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সাবেক সদস্য। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম আইনজীবি ছিলেন।
শেখ ফজলুল হক মনির শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা শেষে বাস্তবে রূপ নিল। কোনো নিরাপত্তা দিয়েই আমরা বঙ্গবন্ধু ও শেখ মনিকে ধরে রাখতে পারিনি। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সাথে শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর স্ত্রী বেগম আরজু মণি (বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নি) শাহাদাৎ বরণ করেন।
শেখ ফজলুল হক মনির রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন ছিল দেশপ্রেম ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। বারবারা বিডলার খ্যাত কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, “সেই একটা সময় ছিল, ত্যাগ-ব্রতের রাজনীতি তাদের ঘিরে যারা জড়ো হতেন তাদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম ছিল। রাজনীতি চর্চার জন্য শিক্ষা ও আদর্শ ছিল, চরিত্রে সংহতি ছিল। তারা দেশের মানুষকে ভোটার বা রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়িই শুধু ভাবতেন না, বড় করে দেখতেন। আমাদের মনি সাহেব ছিলেন এই দলের মানুষ। মনি ভাইকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম।” শেখ মনির রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তার দূরদর্শিতা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলেই তাকে স্মরণ করা সার্থক হবে।
বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতেন শেখ ফজলুল হক মনি। আসুন শেখ মনির দেখানো পথে বাংলার যুব সমাজকে পরিচালিত করি।
তথ্যসূত্র :
*শেখ ফজলে শামস পরশ এর স্মৃতিকথা
*শেখ ফজলে নূর তাপস এর স্মৃতিকথা
*স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিত্ব, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*শেখ মনি – এম এ মুফাজ্জল
*সাংবাদিক মনি ভাই – রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ
*দূরবীনে দূরদর্শী
*বাংলার বাণীর বিভিন্ন সম্পাদকীয়
*ইন্টারনেট
লেখক :
এ্যাডভোকেট শেখ নবীরুজ্জামান বাবু
উপ গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ
সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগ, ঢাবি
বৃত্তিপ্রাপ্ত পিএইচডি গবেষক