আলী আজীম, মোংলা (বাগেরহাট):
সুন্দরবনের দুবলার চরে ৩ দিন ব্যাপী রাসমেলা আজ রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে। রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে ৬ থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী সুন্দরবনের দুবলারচরে ঐতিহ্যবাহী রাস পূর্ণিমায় পূজা ও পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হবে।
কার্তিক-অগ্রহায়ণের পূর্ণিমা তিথিতে প্রতিবছর সুন্দরবনের ‘দুবলার চরে’ বসা এ মেলায় হাজার হাজার পুণ্যার্থী আর পর্যটক ভিড় করে।রাসমেলা মণিপুরীদের প্রধান উৎসব হলেও বাঙ্গালি হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন স্থানে এ উৎসব পালন করে থাকে।
‘রাসলীলা’ নামেও পরিচিত এ উৎসব কার্তিক-অগ্রহায়ণের পূর্ণিমা তিথিতে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, সুন্দবনের দুবলার চর এবং কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতেও পালিত হয়।
শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় শোভিত নিরব সুন্দরবন চরাঞ্চল সরব হয়ে উঠবে পূণ্যার্থীদের পূজা ও আরাধনায়। দূর্গম সাগর-প্রকৃতির অভাবমায় সৌন্দর্য্যরে মাঝে পূর্ণ্য অর্জন আর সঞ্চার যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। কার্তিক-অগ্রহায়ণে শুক্লপক্ষের ভরাপূর্ণিমা সাগর উছলে ওঠে। চাঁদের আলোয় সাগর-দুহিতা দুবলার চরে আলোর কোল মেতে ওঠে রাস উৎসবে।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রাচীন সমুদ্র রাস উৎসব সুন্দরবনের সাগরদুহিতা দুবলারচরে অনুষ্ঠিত হয়। রাস উৎসব নিয়ে নানা মত রয়েছে। ধারণা করা হয়, ১৯২৩ সালে ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসরি হরিভজন নামে এক হিন্দু সাধু এই উৎসব শুরু করেছিল। এই সাধু ২৪ বছরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনের গাছের ফল-মূল খেয়ে জবিন-যাপন করতেন। তিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের স্বপ্নাদৃষ্টি হয়ে পূজা-পর্বনাদি ও অনুষ্ঠান শুরু করেন দুবলার চরে।
তারপর থেকে মেলা বসেছে, লোকালয়ে এই মেলা নীল কোমল মেলা নামে পরিচিত। অন্যমতে হিন্দু ধর্মালম্বীদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ কোন এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপমোচন এবং পূর্ণলাভে গঙ্গাস্নেনর স্বপ্নাদেশ পান। সেই থেকে শুরু হয় রাস উৎসব। আবার কারও কারও মতে শারদীয় দুর্গোৎসবের পর পূর্ণিমা রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সাথে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।
বঙ্গোপসাগরের মোহনায় সুন্দরবনের দুবলাচরে ও আলোর কোলে রাস পুর্ণিমায় রাধাকৃষ্ণের পুজা, পুর্ণ্যস্নন অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষ্যে রাস উৎসবে পুর্ণিমা তিথিতে চরে নির্মিত মন্দিরে নামযজ্ঞ, রাধাকৃষ্ণ, কমল কামিনি ও বনবিবির পূজা অনুষ্ঠিত হবে। অটুট বিশ্বাস আর পুর্ণ ভক্তিতে কমল কামিনীর দর্শন মেলে। পুণ্যার্থীরা কমল কামিনী দর্শনের আশায় নিলকোমলের সাগর মোহনায় সাগর ঢেউঢেয় স্নান করে। রাস পুর্ণিমায় প্রথম আসা সমুদ্র ঢেউকে নিলকোমলের ঢেউ বলা হয়।
এই প্রথম ঢেউয়ে পুর্ণাথিরা তাদের হাতে ধরে রাখা প্রসাদ ঢেউয়ে উৎসর্গ করে, এর পর স্নান শেষে চলে আসে। এ বছর ১৩৯ তম রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। প্রকৃতির অকৃপণ হাতের সৃষ্টি লোনা জলের সাগরের এই রাসমেলায় দূর-র্দূরান্তে তীর্থযাত্রীদের ঢল নামে। ভয়ঙ্কর সুন্দর এই সুন্দরবন। যেখানে একদিকে অ্যাডভেঞ্চার, অন্যদিকে ভয় আর শিহরণ। জলে কুমির, আর ডাঙ্গায় বাঘ। বনের প্রতিটি মূহুর্ত যেন রহস্য আর রোমাঞ্চকের এই মেলায় দর্শনার্থীরা প্রাকৃতিক সৌন্দার্যের অভাবনীয় রূপ উপভোগ করে। প্রতিবছর উৎসবের দিনগুলোতে নিরব সুন্দরবন যেন লোকালয় হয়ে জেগে ওঠে।
হিন্দুধর্মাবলম্বী লোকেরা পুর্ণিমার প্রথম প্রহরে সাগর জলে স্নান করে মনোবাসনা পুর্ণ ও পাপমোচন হবে এ বিশ্বাস নিয়ে রাসমেলায় যোগদিলেও সময়ের ব্যবধানে এ উৎসব নানা ধর্ম ও বর্ণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সময় অসংখ্যক বিদেশী পর্যটকদেরও আগমন ঘটে। আবাল বৃদ্ধ বনিতা, নির্বিশেষে সাগর চর এলাকায় উপস্থিতিতে কোলাহল, পদচালণায় মুখরিত হয়ে উঠবে। প্রতি বছর রাস উৎসব মানুষের মিলন মেলায় রূপ নেয়। সাগরপাড়ে দুবলা ও আলোরকোল চর সমুহে অনুষ্ঠিত রাস উৎসব সুন্দরবনের ঐতিহ্যকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।
পুণ্যস্নানে নিরাপদে যাতায়াতের জন্য দর্শণার্থী ও তীর্থযাত্রীদের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ পাঁচটি পথ নির্ধারণ করেছে। এ সকল পথে বন বিভাগ, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল দল তীর্থযাত্রী ও দর্শণার্থীদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে।
সুন্দরবন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো জানান, এ বছর দুবলার চরের এ মেলায় দর্শনার্থী ও পুণ্যস্নানে নিরাপদে যাতায়াতে তীর্থযাত্রীদের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ পাঁচটি পথ নির্ধারণ করেছে। এসব পথে বন বিভাগ, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের টহল দল তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে।
তিনি আরও জানান, আজ দিনের বেলায় যাত্রা শুরু করতে হবে এবং নৌযানগুলো কেবল দিনের বেলায় চলাচল করতে পারবে। বন বিভাগের চেকিং পয়েন্ট ছাড়া অন্য কোথাও নৌকা, লঞ্চ বা ট্রলার থামানো যাবে না। প্রতিটি ট্রলারের গায়ে রঙ দিয়ে বিএলসি অথবা সিরিয়াল নম্বর লিখতে হবে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অবস্থানকালীন টোকেন ও টিকিট কাছে রাখতে হবে। রাসপূর্ণিমা পুণ্যস্নানের সময় কোনও বিস্ফোরকদ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও বহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারও কাছে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরকদ্রব্য, হরিণ মারার ফাঁদ, দড়ি, গাছ কাটার কুড়াল, করাত ইত্যাদি অবৈধ কিছু পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে বন আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ট্রলারে কোনও প্লাস্টিকের খাবারের প্লেট বহন করা যাবে না। লঞ্চ, ট্রলার, নৌকায় এবং পুণ্যস্নান স্থানে মাইক বাজানো, পটকা, বাজি ফোটানোসহ কোনও প্রকার শব্দ দূষণ করা যাবে না। রাস পূর্ণিমায় আসা পুণ্যার্থীদের সুন্দরবনে প্রবেশের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে প্রাপ্ত নাগরিকত্বের সনদপত্রের মূলকপি সঙ্গে রাখতে হবে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডঃ আবু নাসের মোহসীন হোসেন বলেন, রাসমেলাকে কেন্দ্র করে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক টহল নিয়োজিত থাকবে। রাসপূর্ণিমায় পূজা ও পূর্ণস্নানে আগত তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়ে পশ্চিম বন বিভাগের অভিযান পরিচালনার জন্য কয়েকটি টিম কাজ করবে।
তীর্থযাত্রীরা যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে তার জন্য সব রকম সহযোগিতা দেওয়া হবে বলেও জানান এ বন কর্মকর্তা।