অপরাধ ডেক্সঃ
এ দিনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে– এই দিনেই তেলিয়াপাড়া চা বাগান থেকে মুক্তিবাহিনী গঠন এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সুচনা হয়। এ স্থান ছিল মুক্তিবাহিনীর প্রথম সদর দপ্তর। এ স্থানের অধিকার টিকিয়ে রাখতে ৩নং সেক্টর প্রধান মেজর কে এম সফিউল্লাহর অধিনায়কত্বে বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাতে ৮৩জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন পক্ষান্তরে ২১০জন হানাদার সদস্য নিহত হয়।
একাত্তরে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যখন পাকিস্তানের স্বাভাবিক রাজনীতি কলুষিত হয় ঠিক তখনই বাঙালি সেনারা স্বউদ্যোগে যে যার অবস্থান থেকে বিদ্রোহ করে গণ-প্রতিরোধে অংশ নেয়। সমন্বয়হীন ও বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের এই তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ দেশের মানুষের কাছে আশির্বাদ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু যুদ্ধের জন্য একক, সঠিক ও সুশৃঙ্খল নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সেই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সরকারের অবর্তমানে সমস্যার আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে সমস্ত বিষয় অগ্রগণ্য, তার সবকটির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী হবিগঞ্জ জেলাধীন মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তেলিয়াপাড়ার সেই গৌরবগাঁথার বিবরণ অনুপস্থিত।
তেলিয়াপাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ একটি স্থান-নাম। তেলিয়াপাড়াকে পাশ কাটিয়ে কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পূর্ণতা পেতে পারে না। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয় এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নীতি নির্ধারণী সর্বমোট যে তিনটি সভা অনুষ্ঠিত হয় তার প্রথম দুটি সভাই তেলিয়াপাড়া সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়। কেবলমাত্র তৃতীয় ও শেষ সভাটি কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডস্থ বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এ স্থানকে ইঙ্গিত করেই তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম বেতার ভাষণে পূর্বাঞ্চলে সরকারী কাজ পরিচালনার জন্য সিলেট-কুমিল্লা এলাকায়’ বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ের উল্লেখ করেছেন। এসব কারণে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও সন্দেহাতীত ভাবেই প্রমাণিত হয় যে, তেলিয়াপাড়াই বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে মুক্তিবাহিনীর প্রথম সেনা সদর দপ্তর ছিল। মুজিবনগর প্রথম বাংলাদেশ সরকার ঘোষণার জন্য স্মরণীয় বটে, তেলিয়াপাড়া তারও পূর্বেকার মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনাকেন্দ্র এবং বিশাল যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে স্মরণীয়। তেলিয়াপাড়ার ঐতিহাসিক ভূমিকার বিবরণ মৎপ্রণীত মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিসাক্ষী তেলিয়াপাড়া শীর্ষক গ্রন্থে তথ্য-প্রমাণসহ বিবৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
তেলিয়াপাড়ায় সদর দপ্তর স্থাপন ও মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা:
কুমিল্লা সেনানিবাসস্থ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী অধিনায়ক লে. কর্নেল মালিক খিজির হায়াত খান ২৭ মার্চ তার ব্রিগেডের বাঙালি সেনাদের বিভ্রান্ত ও নিরস্ত্র করার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর শাফায়াত জামিলের ইউনিটে একটি কনফারেন্স ডাকেন। অবস্থার ভয়াবহতা অনুমান করে সমশেরনগরে অবস্থানরত রেজিমেন্টের সহ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে যোগাযোগ করে সকাল ১০টায় কনফারেন্স শুরুর সাথে সাথেই অতর্কিতে অধিনায়ক খিজির হায়াত, মেজর নেওয়াজ ও ক্যাপ্টেন আমজাদকে গ্রেফতার এবং মোট ৭২ জন পাকসেনাকে হত্যা করেন।
বেলা ১১টায় মেজর খালেদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে বিদ্রোহী শাফায়াত জামিলের বাহিনীর সাথে মিলিত হন এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করে রাতেই পার্শ্ববর্তী মাধবপুরে সংশ্লিষ্ট রেজিমেন্টের সদর দপ্তর স্থাপন করেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন বিদ্রোহী ইউনিটসহ ভারতীয় বিএসএফ কর্মকর্তাদের সাথেও যোগাযোগ স্থাপন করেন। মাধবপুর সদর দফতরে সংরক্ষিত অবস্থায় ব্র্যাভো কোম্পানিকে রেখে বাকী ইউনিটগুলোকে কৌশলগত ভাবে বিভিন্ন স্থানে তিনি মোতায়েন করেন।
২৮ মার্চ সকালে মেজর খালেদ মোশাররফ বিএসএফর পূর্বাঞ্চলীয় মহা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট থানার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের পাশে অবস্থিত তেলিয়াপাড়া বিওপিতে যান। পাহাড়িয়া এলাকার ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে বিওপি ও অদূরবর্তী বিএসএফ ক্যাম্পের মধ্যবর্তী স্থানে ব্রিগেডিয়ার পান্ডের সাথে তাঁর কথা হয়।
ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের সুবিধার জন্য ঘনজঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাতায়তের সুবিধার্থে রাস্তার আবশ্যকতা বোধ করে মেজর খালেদ স্থানীয় সহযোগিতা চাইলে রাতের মধ্যেই চা শ্রমিকরা বিওপি থেকে বিএসএফ ক্যাম্প পর্যন্ত সংযোগ রাস্তা নির্মাণ করেন।
মেজর খালেদ মোশাররফ ২৯ মার্চ তাঁর রেজিমেন্টের সদর দপ্তর মাধবপুর থেকে তেলিয়াপাড়া বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় স্থানান্তর করেন। অপরদিকে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সহ-অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহ বিদ্রোহ করে কিশোরগঞ্জে অবস্থান কালে মেজর খালেদের বার্তা পান এবং তাঁর বাহিনী নিয়ে ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের সাথে যৌথভাবে সদর দপ্তর স্থাপন করেন।
বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত যুদ্ধের সমন্বয় এবং পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে মেজর খালেদ মোশাররফ ও বিএসএফর যৌথ উদ্যোগে ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া বাগানে একটি সেনাসভা আহ্বান করা হয়। সভায় যোগদানের জন্য তেলিয়াপাড়া সদর দপ্তরে ৩ এপ্রিল মেজর খালেদ এবং মেজর সফিউল্লাহ যখন নিজ নিজ এলাকা বিভক্ত করে সৈন্য সমাবেশে ব্যস্ত ঠিক তখন চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়াউর রহমান এসে তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
৪ এপ্রিল সকালেই বিদ্রোহী সেনা ইউনিট সমূহের অধিনায়কেরা তেলিয়াপাড়া সদর দপ্তরে এসে পৌঁছেন। ১০টায় বিএসএফর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল কর্নেল ওসমানীকে সাথে নিয়ে সদর দপ্তরে পৌঁছলে সভার কাজ শুরু হয়। ঐতিহাসিক এই সেনাসভায় কর্নেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী এমএনএ, লে. কর্নেল (অবঃ) এম এ রব এমএনএ, লে. কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল সভায় যোগদান করেন।
সভার কার্যক্রম শুরু হলে এর লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন মেজর খালেদ মোশাররফ। সভায় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রেশন সরবরাহের বিষয়ে ভারতের পক্ষে ব্রিগেডিয়ার পান্ডের আশ্বাস প্রদান; ভারতীয় ভূখণ্ডে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং শরনার্থী শিবির স্থাপনের জন্য ওমেস সায়গলের আশ্বাস প্রদান; দেশটিকে ৪টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান; নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও রাজনৈতিক সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব দেয়াসহ মোট ১০টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ঐদিনই মেজর সফিউল্লাহর অধীন ২ ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বাধীন বি কোম্পানি
ঐতিহাসিক এ সভার বর্ণনায় মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বলেন, এ সভা আমাদের বাহিনীকে সাংগঠনিক ধারণা দেয় এবং তা মুক্তিবাহিনী পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে। তিনি বলেন, সভা শেষে কর্নেল ওসমানী তাঁর রিভলভার থেকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন।’
৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত মূল্যায়ন ও পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় ২য় সেনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় প্রথম সভার সিদ্ধান্তানুযায়ী বিভক্ত ৪টি সামরিক অঞ্চলকে ৬টিতে উন্নীত করে রংপুর ও আংশিকভাবে দিনাজপুর অঞ্চলে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকে এবং রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া অঞ্চলে মেজর নাজমুল হককে অধিনায়ক করা হয়। কর্নেল ওসমানী শীঘ্রই তাজউদ্দীন আহমেদ কর্তৃক বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা এবং ভারত কর্তৃক প্রতিশ্রুত সহযোগিতার তথ্য উপস্থাপন করেন।
১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় ২য় ও ৪র্থ বেঙ্গলের যৌথ সদর দপ্তর স্থাপনের পরই সেখানে ছাত্র-জনতাকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দানের প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথম ব্যাচে ২০০০ যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়। ১০ এপ্রিলের সভায় ৬টি সেক্টর বিন্যস্থ হলে ৩নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ তেলিয়াপাড়াকেই তাঁর সদর দপ্তর করে সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করেন।
তেলিয়াপাড়া থেকে গৃহীত প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
মেজর খালেদ মোশাররফ ২৯ মার্চ তেলিয়াপাড়ায় তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করে সেখান থেকে তাঁর বাহিনী বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করেন। তাঁর অগ্রবর্তী সৈন্যদের কোম্পানীগঞ্জে লড়াই হয়। তেলিয়াপাড়ায় তাঁর কমান্ডে সিলেট সেক্টরের ১নং, ৩নং এবং ১২নং উইং ইপিআর-এর বেশ কয়েকটি কোম্পানি বিভিন্ন রণাঙ্গনে বেশ কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। ৩০/৩১ মার্চ তিনি ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, ছুটি ভোগরত সৈনিক, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং অন্যান্যদের মিলিয়ে এক-একটি কোম্পানি এক-একজনের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন নাসিমের নেতৃত্বে সুবেদার মান্নান একটি কোম্পানি নিয়ে আশুগঞ্জ, সুবেদার ফরিদের নেতৃত্বে শুভপুর সেতু, ক্যাপ্টেন সায়গল এবং সুবেদার মজিবুর রহমান তেলিয়াপাড়া এবং মেজর খালেদ নিজে একটি কোম্পানি নিয়ে বেলুনিয়ার দিকে অগ্রসর হলেন।
১ এপ্রিল মেজর কে এম সফিউল্লাহ তেলিয়াপাড়া এসে তাঁর সাথে যোগ দেন এবং সেখানে ২ ও ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যৌথ সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। ৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া সম্মেলনের পর সেখান থেকে সেনা নায়কগণ তাঁদের সুবিধামত মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস করেন। তখন থেকে তেলিয়াপাড়াকে ৩নং সেক্টরেরও সদর দপ্তর করে আধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ ১৯ মে পর্যন্ত সেখানকার অধিকার ধরে রাখেন।
মেজর সফিউল্লাহ তেলিয়াপাড়ায় তাঁর সদর দফতর স্থানান্তরের পর সেখানে যোগদান করা পুলিশ, ইপিআর এবং ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তখন মেজর নূরুল ইসলাম ছিলেন তাঁর সহ অধিনায়ক এবং লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন এডজুটেন্ট। মেজর সফিউল্লাহ তাদেরকে অবিলম্বে তেলিয়াপাড়ায় প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। এ সময়ে প্রথম ব্যাচে ২০০০ যুবককে দুসপ্তাহের প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করা হয়। পুরোদমে প্রশিক্ষণের কাজ চলতে থাকে। এপ্রিলের ৪ তারিখে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টার থেকে মেজর সফিউল্লাহ মেজর মঈনের পরিচালনায় তেলিয়াপাড়ায় ডেল্টা কোম্পানিকে রেখে তার বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে নরসিংদী, আশুগঞ্জ, লালপুর, আজবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সরাইল, শেরপুর-সাদীপুরে প্রেরণ করেন।
১৩ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ভৈরব বাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে প্রচন্ড বিমান আক্রমণের সম্মুখীন হয়। ১৩ থেকে ১৫ এপ্রিল ভৈরব-আশুগঞ্জ-লালপুর এলাকায় মেজর সফিউল্লাহর বাহিনীর যুদ্ধ হয়। ২১ এপ্রিল পাক বাহিনীর সাথে শাহবাজপুরে এবং ২৮ এপ্রিল মাধবপুরে তাদের প্রচÐ যুদ্ধ হয়।
২৯ মার্চ থেকে মেজর সফিউল্লাহ দেশের পূর্বাঞ্চলে তাঁর সেক্টর এলাকায় পাকবাহিনীর মোকাবেলায় বহু যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। স্থানীয় ভাবে মৌজপুর, নোয়াপাড়া, শাহাপুর, শাহজীবাজার, আন্দিউড়ায়, নলুয়া চা বাগান, চান্দপুর চা বাগান, লালচান্দ চা বাগান, তেলিয়াপাড়া-চুনারুঘাট রাস্তা, ধর্মঘর বাজার, মাধবপুর থানা সদর, হরষপুর প্রভৃতি স্থানে অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তেলিয়াপাড়া হেড কোয়ার্টারে পাকবাহিনীর বেশ কয়েকটি আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি ১৯ মে পর্যন্ত তেলিয়াপাড়া নিয়ন্ত্রণ করেন।
পাকবাহিনী ১৬ মে তেলিয়াপাড়া অতিক্রম করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার সময় ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যামবুশে পড়লে ৪০ জন পাকসেনা নিহত হয়। লে. হেলাল মোরশেদও একটি অপারেশনে প্রায় ৫০ জন পাকসেনাকে হতাহত করতে সক্ষম হন।
৬ মে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে পাকবাহিনী অতর্কিতে একটি শক্তিশালী হামলা চালায়। ক্যাপ্টেন মতিন সাহসিকতার সাথে তা মোকাবেলা করেন। ১৯ মে ওরা সেখানে পুনরায় একটি শক্তিশালী আক্রমণ রচনা করলে লে. হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে তা প্রতিহত করার চেষ্ঠা করা হয়। কিন্তু তাদের সামরিক শক্তি অধিক থাকায় শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পরাস্ত হতে হয়। এ যুদ্ধে ২০/২৫ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়াকে তাদের আয়ত্বে নেয়ার জন্য প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য দিয়ে ক্রমাগত ২১ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালায়। এতে মোট ৮৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেও প্রায় ২১০ জন পাকসেনা নিহত হয়।
মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় এই তেলিয়াপাড়া থেকেই। এখান থেকেই আমরা একক নেতৃত্বে যুদ্ধ শুরু করি এবং একটি পলিটিক্যাল আমব্রেলা অর্থাৎ রাজনৈতিক সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করি। তেলিয়াপাড়া কেবল আমার হেডকোয়ার্টারই ছিল না এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা কেন্দ্র ও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম হেডকোয়ার্টার।
মুক্তিযুদ্ধে তেলিয়াপাড়ার ঐতিহাসিক স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য কুমিল্লা সেনানিবাসের উদ্যোগে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে সেখানে নির্মিত হয় একটি বুলেটাকৃতির স্মৃতিসৌধ যা উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ।
মুজিবনগরের মতো এখানেও একটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি ও উপযোগিতা থাকা সত্ত্বেও সরকারি উদাসীনতায় স্থানীয় জনতার পাশাপাশি এখানে আগত সকল শ্রেণির পর্যটকও মর্মাহত। সর্বস্তরের মানুষের দাবি, মহান মুক্তিযুদ্ধে তেলিয়াপাড়ার অবদানকে স্মরণীয় করার জন্য ৪ এপ্রিলকে তেলিয়াপাড়া দিবস’ ঘোষণাসহ মুক্তিযুদ্ধ চত্বর-চুনারুঘাট সড়ক থেকে স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত রাস্তার পাশে একটি যুদ্ধক্ষেত্র, বাংলোকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ঘোষণা, সংশ্লিষ্ট সভায় ভারতীয় কর্মকর্তাসহ উপস্থিত সদস্যদের মূর্তিসম্বলিত কনফারেন্স ভাষ্কর্য, গবেষণাগার ও সেমিনার ভবন, হানাদার বাহিনীর উদ্দেশ্যে ধিক্কার স্তম্ভ, আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রসহ একটি স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে।
(সংগৃহিত)