।।ওসমান গনি।।
এক সময় দেশ গ্রামের মানুষ সুখ শান্তি আর স্বচ্ছলভাবে জীবন ধারনের জন্য শহরে ভীর জমাত। তখন মানুষের ধারনা ছিল যে শহরে গেলেই বুঝি সুখ শান্তি আরামে বসবাস করা যায়। হয়ত অনেকের কপালে সুখ শান্তি জুটেছে আবার অনেকেই অতিকষ্টে দিনাতিপাত অতিক্রম করছে। সে সময়ে শহরে কাজ ছিল প্রচুর। যার জন্য গ্রামের মানুষ গ্রামে কোন কাজ না থাকলে শহরমূখী হতো। আর এই সুযোগ কাজে লাগাত ঢাকার শহরের বাড়ির মালিকরা। তারা তাদের ইচ্ছামতো বাড়ির ভাড়া বাড়াতো। কার কি পরিমান কাজ, রোজগার কত সে দিকে তারা তাকাত না। তখন অনেকেই বাধ্য হয়ে বাড়িওয়ালার বাড়ানো অতিরিক্ত ভাড়াতে থাক। তারপরও তাদের তেমন কোন কষ্ট হচ্ছিল না। কারন কাজ ছিল প্রচুর। আর দেশের বাড়তি লোকদের চাপে শহরগুলোতে সবসময় মানুষের গেঞ্জাগেঞ্জি লেগেই থাকত। আর ট্রাফিক জ্যাম ছিল চিরসাথী। কিন্তু গত মার্চ মাস হতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রমন শুরু করে। দিন দিন বাড়তে থাকে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। যার জন্য সরকার সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষনা করে। বন্ধ হয়ে যায় দেশের শিল্পকারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। শিল্পকারখানার মালিকরা ছুটি দিয়ে দেয় শ্রমিকদের, দোকাম মালিকরা ছুটি দিয়ে দেয় তাদের কর্মচারীদের। তখন সমস্ত মানুষ তাদের জীবন বাচানোর জন্য গ্রামে চলে যায়। আস্তে আস্তে ফাকা হতে থাকে দেশের শহরগুলো। জনশূন্য হয়ে পড়ে দেশের রাজধানী। লোকজন গ্রামে চলে যাওয়ার পর শহরের বাড়ির মালিকরা পড়ে যায় বড় মহাবিপদে। তারপরও অনেকেই আশস্থ ছিলেন দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শহরে এসে আবার কাজ করবে। কিন্তু তা হয়নি। করোনার পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। যার জন্য অনেকেই ছোট ছোট শিল্পকারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে গ্রামে নিজ জন্মস্থানে চলে যাচ্ছে। কারন ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার কারনে আয় রোজগার কমে গেছে। ঢাকাতে থাকার কোন পরিস্থিতি নাই। যার জন্য শহর ছাড়তে হচ্ছে। এতে করে এক এক করে শহরের বাড়িগুলো ফাকা হতে শুরু করছে। শহরের বাড়িওয়ালারা পড়ে গেছে মহাবিপদে। তাদের রোজগারের পথ ছিল বাড়ি ভাড়া। এখন দেশের সাধারণ মানুষের পর্যায়ে চলে আসছে তারা। তাদের সাথে একই অবস্থা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের লোকজনেরও। কাজকর্ম না থাকার কারনে অনেকেই এখন বোবার মতো তাদের তল্পিতল্পা নিয়ে গ্রামে ছুটে চলে আসছে। অনেকে আবার হাসিঠাট্টা করে বলছে শহরে আর শান্তি নাই, চল রে ভাই গ্রামে যাই। তাদের অনেকের ই এমন ধারনা না খেয়ে যদি মরতেই হয় তাহলে গ্রামে গিয়ে মা বাবার সাথে মরব।
পরিসংখ্যান মতে, গত ২০ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া অনেকগুণ বেড়েছে। এরই মধ্যে খাবার খরচ, শিক্ষা, যাতায়াত, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ বিল, গ্রামে থাকা মা-বাবার দেখভাল আর মোবাইল বিল খরচ করে পকেটে আর কিছুই থাকে না। প্রতি মাসের শেষ কটা দিন ধারদেনা করে চলে, কোনো সঞ্চয় নেই, তাই এই বাড়িভাড়ার চাপেই শহর ছাড়ছে মানুষ। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে নিম্নবিত্তের কাতারে নেমে যাবেন বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিসংখ্যান মতে, দেশে ৯০ লাখ মানুষ সরকারী ও বেসরকারী খাতে চাকরি করেন। এর মধ্যে ১৫ লাখ সরকারি খাতে। বাকি ৭৫ লাখ মানুষ বেসরকারি খাতে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন ছয় কোটি ৮ লাখ মানুষ।
অপর দিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, করোনায় দেশে নতুন করে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ গরিব হয়েছেন। দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যুক্ত হওয়া নতুন এ সংখ্যার ফলে এখন দেশে গরিব মানুষ পাঁচ কোটির বেশি। বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালকের আশঙ্কা, অর্থনীতির যে স্থবির অবস্থা, তা যদি আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে, তাহলে ৩০ শতাংশ মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে।
গবেষণা সংস্থাটি বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের ওপর মূল চাপ কতটা পড়বে কিংবা তারা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নির্ভর করবে অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়ায় তার ওপর। চলতি জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা বুঝা যাবে। বিআইডিএস গবেষকদের মতে, বাজেটে একটা প্রাক্কলন করা হয়েছে চলতি বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টার থেকে তৃতীয় কোয়ার্টারের মধ্যে অর্থনীতি ৫০ শতাংশ ঘুরে দাঁড়াবে। যদি তা হয় তাহলে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেয়া যাবে। আর যদি ঘুরে না দাঁড়ায় তাহলে মধ্যবিত্তের জন্য আরো কঠিন পরিস্থিতি আসবে। জুন পর্যন্ত তথ্য তুলে ধরে বিআইডিএসের জরিপে বলা হচ্ছে, বেসরকারি খাতের চাকরির আয় এরই মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। একটি অংশের চাকরি আছে, কিন্তু বেতন নেই। আবার কারো বেতন কমে গেছে। এসএমই সেক্টরে ধস নেমেছে। এসব কারণে অসচ্ছল ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। যার সংখ্যা হবে দেড় কোটি থেকে আড়াই কোটির মতো। করোনায় এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। এ অবস্থায় চলতি বছরের তৃতীয় কোয়ার্টারের ওপরই নির্ভর করবে আমাদের অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াবে আর মধ্যবিত্ত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া দেড় থেকে আড়াই কোটির মতো নতুন দরিদ্রের অধিকাংশই অসচ্ছল ঝুঁকিপূর্ণ পরিবার। কারণ এ সময় তাদের মজুরি শ্রমের কোনো সুযোগ ছিল না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও কোনো ব্যবসা ছিল না। তবে মধ্যবিত্তের হিসাবটা একটু জটিল। তাদের মূল আশ্রয়স্থল হলো তারা মাসিক বেতনের ভিত্তিতে চাকরি করে। ব্যাংকের সাথে মধ্যবিত্তদের একটা লেনদেন আছে। তাদের মোটামুটি একটা সঞ্চয় আছে। কিন্তু অর্থনীতির যে স্থবির অবস্থা, এ রকম যদি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে, তাহলে ৩০ শতাংশ মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা জরিপ অনুযায়ী করোনার আগে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২০.৫ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। আর চরম দরিদ্র ছিল ১০ শতাংশ। অপর দিকে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, এক জনের দৈনিক আয় এক ডলার ৯০ সেন্ট হলে ওই ব্যক্তিকে দরিদ্র ধরা হয় না। এর নিচে হলে দরিদ্র। মধ্যবিত্তের আয় সম্পর্কিত বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি একটু বেশি। তাদের মতে, প্রতিদিন যাদের আয় ১০ থেকে ৫০ ডলার তারা মধ্যবিত্ত।
অন্য দিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, এক ব্যক্তির ক্রয়ক্ষমতা (পিপিপি) যদি প্রতিদিন দুই ডলার থেকে ২০ ডলারের মধ্যে হয় তাহলে তাকে মধ্যবিত্ত বলা যায়। এই হিসাবে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত হলো তিন কোটি ৭ লাখ। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুই থেকে চার ডলার প্রতিদিনের আয় হলেই মধ্যবিত্ত। সেই হিসাবে যার মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা সেই মধ্যবিত্ত। এটা দেশের জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ। ১৬ কোটি মানুষের হিসাবে সংখ্যাটি দাঁড়ায় চার কোটি ৮০ লাখ।
দিনে ১.৯ ডলারের দ্বিগুণ যাদের আয় তাদের বলা হয় নিম্ন মধ্যবিত্ত। এরাই এখন সবচেয়ে বেশি সঙ্কটের মুখে আছেন। তারাই হয়তো দরিদ্রের কাতারে নেমে গেছেন। কিন্তু যারা মধ্যবিত্ত, তারা এখনো টিকে আছেন। তাদের সংখ্যা হয়তো ঠিকই থাকবে। হয়তো ব্যক্তির পরিবর্তন হবে। কারণ নতুন পরিস্থিতিতে পেশার পরিবর্তন হবে। নতুন ধরনের ব্যবসা আসবে, কাজ আসবে। কেউ ভালো অবস্থায় যাবেন। আবার কেউ খারাপ অবস্থায় পড়বেন।
কিন্তু বিআইডিএসের জরিপ বলছে, করোনায় ফর্মাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম তাদের ৫৬.৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। ৩২.১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩.২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭.২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯.৪ শতাংশের আয় কমেছে এবং ৬.৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে।
দেশের এমন পরিস্থিতি থেকে নিজেকে ও দেশ কে রক্ষা করতে হলে গ্রামীণ কৃষির বিকল্প কিছুই নাই। দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা বা সচল করার একটাই পথ সেটা হলো গ্রামীণ কৃষি।