কুমিল্লার খাদি সারাবিশ্বে সমাদৃত

প্রকাশিত: ৪:২৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৭, ২০২০

ওসমান গনি।।

কুমিল্লার খাদি পণ্য বাঙালীর শত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চেতনাকে লালন করছে। মানুষের দৈনন্দিন ফ্যাশন জগতের এক বিশ্বস্ত বস্ত্রের নাম খাদি বা খদ্দর পোষাক। যা কুমিল্লার খাদি বা খদ্দর নামে পরিচিত। এ কাপড় খাদে (গর্তে) বসে তৈরি করা হয় বলে এর নাম দেয়া হয়েছে খাদি।
কুমিল্লার খাদি কাপড়ের চাহিদা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। হাতে বোনা কাপড়কে আমাদের এ উপমহাদেশের মানুষ জানে খাদি হিসেবে। খদ্দর শব্দটি গুজরাটি, খদ্দর থেকে খাদি। শব্দটির আভিধানিক অর্থ কার্পাস তুলা থেকে হাতে কাটা সুতা দিয়ে হাতে বোনা কাপড়। খাদি শুধুমাত্র হাতে তৈরি কাপড় নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে ভারত বর্ষের স্বাধিকার আন্দোলন ও বাঙালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য। যার চাহিদা দেশ বিদেশে এখনও ব্যাপক মাত্রায় রয়েছে। খাদি কাপড়টির বৈশিষ্ট্য হলো এটা মোটা কাপড়।
১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে তখন ভারতবর্ষের সবাই বিদেশী পণ্য বর্জন করার ফলে কুমিল্লায় খদ্দর বা খাদি শিল্প প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখন খাদি কাপড় তৈরি হতো রাঙ্গামাটির তূলা থেকে। জেলার চান্দিনা, দেবিদ্বার, বুড়িচং ও সদর থানায় সে সময় বাস করতো প্রচুর যুগী বা দেবনাথ পরিবার। গান্ধীজী প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লার অভয় আশ্রম খাদি শিল্প প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনুশীলন চক্রের আশ্রয় স্থল হিসেবে ছদ্ম বরণে প্রতিষ্ঠিত সমাজ কল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভয় আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৩০ সালে কুমিল্লার বরকামতায় (বর্তমানে চান্দিনা) চরকায় কাটা সুতা ও তকলীতে কাপড় তৈরির কাজ চলতো। তৎকালে সেখানে ডায়িং মাস্টার হিসাবে কাজ করতেন চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা শৈলেন্দ্রনাথ গুহ। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কুমিল্লা শাখা থেকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা হলে খাদি শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। তবে খাদি শিল্পের এ বিপর্যয় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫২ সালে সমবায় আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্ণর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লার অভয়াশ্রমে দি খাদি এন্ড কটেজ ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ভারতবর্ষে সর্বত্র এক আওয়াজ উঠে ‘মোটা কাপড়-মোটা ভাত’। সেই মোটা কাপড় এখন মিহি হয়েছে। কাপড়ে লেগেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া।

কুমিল্লার খাদি এখন শৈল্পিকতার ছোঁয়ায় দেশ-বিদেশে সমাদৃত হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সুপরিচিত খাদিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশের চাহিদা পূরণ করে খাদি কাপড় রপ্তানি হচ্ছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এ সুনাম অর্জিত হয়েছে বহু বছর ধরে অনেক কারিগর আর ব্যবসায়ীর অক্লান্ত পরিশ্রমে। এক সময় সংগ্রামী মানুষ আর গরীবের পোষাক বলে পরিচিত হলেও খাদি কাপড় এখন ফ্যাশনে সময়ের চাহিদা মেটাচ্ছে। খাদি কাপড়ের সাথে এখন কয়েকটি দিক জড়িত রয়েছে। তা হচ্ছে তাঁতী, সুতা কাটুনী, ব্লক কাটার ও রঙের কারিগর। সবাই মিলে তৈরি করেন নান্দনিক খাদি কাপড়। বর্তমানে কুমিল্লা জেলায় এক থেকে দেড় হাজার পরিবার এই পেশায় জড়িত। মহানগরে খাদি কাপড়ের দোকান রয়েছে শতাধিক।
কুমিল্লার খাদি কাপড়ের প্রবীণ ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লা মহানগরের ‘অভয় আশ্রম’ একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। অভয় আশ্রমের কর্মীদের প্রচেষ্টায় কুমিল্লার আশ-পাশের গ্রামগুলোতে হাতে সুতা কাটা ও হস্তচালিত তাঁতের ব্যবহার ব্যাপক ভাবে শুরু হয়। বিশেষ করে কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া। দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা, সাইতলা, বাখরাবাদ, বেলাশ্বর, ভানী, হারং, গুনঞ্জর। দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর। মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর, রামকৃষ্ণপুর, ঘোড়াশাল, ময়নামতি, জালালপুর, মইনপুর এলাকায় হস্তচালিত তাঁত শিল্পের প্রসার ঘটে। এই তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে বারেরা, রামচন্দ্রপুর, জাফরাবাজ, সায়কট, বাবিরচড়, কুটুম্বপুর, কলাগাঁও ইত্যাদি গ্রামগুলোতে গরিব জনগোষ্ঠী হাতে সুতা কাটার পেশায় জড়িয়ে পড়ে।
খাদি শিল্পের প্রসারে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা যারা রেখেছেন কুমিল্লা মহানগরের খাদি ঘরের তরণী মোহন রাহা, খাদি কুটির শিল্পের শংকর সাহা, খাদি ভবনের দীনেশ দাশ, বিশুদ্ধ খদ্দরের মনমোহন দত্ত, রাম নারায়ণ স্টোরের কৃষ্ণ সাহা।
তাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। বর্তমানে কুমিল্লার খাদি পোষাকের মধ্যে পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সেলোয়ার কামিজ, ওড়না, বিছানার চাদর, গায়ের চাদরসহ ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রীতে নজরকাড়া ডিজাইন আনা হয়েছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে খাদির সব ধরণের পোষাকে আধুনিকতা আসলেও খদ্দরের সেই মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি এখনও আগের জৌলুস ধরে রেখেছে। খাদির পোষাক যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি পরতেও আরামদায়ক।




error: Content is protected !!