সিলেট থেকে ৯২ কিলোমিটার দূরে জকিগঞ্জ। যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু রাস্তার খারাপ অবস্থার কারণে কখনো কখনো তিন ঘণ্টাও লেগে যায়। ভারতের এলাহাবাদে যেভাবে ত্রিবেণীসঙ্গমে মিশেছে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী, তেমনিভাবে বাংলাদেশের জকিগঞ্জে মিশেছে বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারা। ভাবলাম কাজটা করে আসতে পারবো, সঙ্গে দেখে আসতে পারবো তিন নদীর মিলন স্থান।
সকাল বেলায় প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছি। যার সঙ্গে যাব তার দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি এলেন ১১টায়। গাড়িতে করে যাত্রা শুরু হলো। খানাখন্দে ভরা রাস্তায় যেতে যেতে শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তবে রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতে হয়। মাঝে মাঝে ছবি তুলছি।
আড়াই ঘণ্টার মধ্যে আমরা এসে পৌঁছালাম জকিগঞ্জে। দেখা পেলাম জকিগঞ্জ পৌর পাঠাগারের সঙ্গে শহীদ মিনারের। গাড়ি থেকে নেমে স্থানীয় হোটেলে রানী মাছ দিয়ে ভাত খেতে বসলাম। খাওয়া শেষ করে চললাম গন্তব্যে। পথে দেখলাম প্রচুর সুপারি বাগান। সঙ্গী আফতাব ভাই বললেন, জকিগঞ্জের সুপারির বেশ সুনাম। এখানকার সুপারির রং যেমন চমৎকার, স্বাদও অসাধারণ। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি সুপারিগাছ। পৌঁছে গেলাম আফতাব ভাইয়ের বাড়িতে। আমি দ্রুত অফিসের কাজ শুরু করে দিলাম। কাজ শেষ করে ছুটে চললাম তিন নদীর মিলনস্থল দেখতে।
কুশিয়ারা তীরের কাস্টমস ঘাটে এসে পৌঁছালাম। খরস্রোতা নদী। আফতাব ভাই বললেন, এ প্রান্তে বাংলাদেশের পূর্ব-উত্তর কোণের সর্বশেষ উপজেলা জকিগঞ্জ, অপর প্রান্তে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলা। পাশেই সীমান্তরক্ষীদের সতর্ক প্রহরা। দুই দেশের মাঝখানে নদীটি আছে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হয়ে। নৌকাগুলোতে কোনোটিতে বাংলাদেশের পতাকা আবার কোনোটিতে ভারতের পতাকা টাঙানো। ছবি তুললাম।
আমরা যাব আমলসীদ পয়েন্ট, যেখানে মিলিত হয়েছে তিন-তিনটি নদী। জকিগঞ্জ সদর থেকে উত্তর-পূর্বমূখী রাস্তা ধরে ১৩ কিলোমিটার যাওয়ার পর পড়ল আমলসীদ বাজার। সেখান থেকে একটু সামনে গিয়ে ডানে মোড় নিলাম। মোড় থেকে একটু সামনে গিয়ে টিলার মতো একটা উঁচু ঢিবি। কিছুদূর যাওয়ার পর
রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। গাড়ি সামনে যাবে না। অগত্যা গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে রওনা দিলাম। কয়েক মিনিট হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত গন্তব্যে।
নদীর স্রোতধারা বলে দিচ্ছে এটি যে তিন নদীর মিলনক্ষেত্র। ভারতের মণিপুরে জন্ম নেওয়া বরাক মিজোরাম আর আসামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আমলসীদে এসে দুই ধারায় ভাগ হয়েছে। এই দুটিই আমাদের সুরমা ও কুশিয়ারা। দুই নদী জকিগঞ্জ উপজেলাকে তিন দিক থেকে জড়িয়ে আছে। দেখা পেলাম নদীর পাশে নানা রকমের সবজি ক্ষেত। আমাদের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী টহল দিচ্ছে। পানকৌড়ি, সারস, বকসহ অচেনা বেশ কিছু পাখি দেখলাম। হঠাৎ করে শব্দ হলো, দেখলাম বড় একটি মাছ ধরা পড়েছে পেতে রাখা ফাঁদে। বাঁশ-বেত দিয়ে বানানো এক ধরনের বড় আকৃতির মাছ ধরার ফাঁদ, স্থানীয় নাম ‘ফর্গা’।
পানির ওপর কয়েকটি ফর্গা উঁচু হয়ে ভেসে আছে। একজন বয়স্ক লোক ছুটে এলেন। এসেই নৌকা নিয়ে ছুটে গেলেন মাছ ধরতে। বড় একটা আইড় মাছ ধরা পড়েছে ফর্গাতে। বরাক মোহনার এই মিলিত স্রোতের বিশেষত্ব হচ্ছে এখানটায় প্রায় সারা বছরই পানির যথেষ্ট প্রবাহ থাকে। শুষ্ক মৌসুমে এমন স্রোত দেশের অনেক নদীতেই দেখা যায় না। আমলসীদ পয়েন্টে তিন নদীর আকৃতি অনেকটা ইংরেজি ‘ওয়াই’ অক্ষর উল্টো করে ধরলে যে রকম দেখায়, অনেকটা সে রকম। নদীর পাড়ে নানা জাতের বাহারি লতা-গুল্ম আর নলখাগড়ার বন পেরিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম।
সূর্য বিদায় নেওয়ার সময় অসাধারণ এক দৃশ্য। নদীর বুকে সন্ধ্যা নামছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম সিলেটের উদ্দেশে।
যাবেন কীভাবে
সিলেটের কদমতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে জকিগঞ্জের উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। বাস ভাড়া ১২০ টাকা। জকিগঞ্জ উপজেলায় যাওয়ার পথে কালীগঞ্জ লাইনে পড়বে আমলসীদ পয়েন্ট। সেখানে দেখা পাবেন তিন নদীর মিলন স্থান। চাইলে সিলেট ভাড়া করে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। তবে বাসে গেলে নিশ্চিত হয়ে নেবেন বাস কালীগঞ্জ হয়ে যাবে কি না। দিনে দিনেই সিলেটে ফেরা যাবে জকিগঞ্জ থেকে। গাড়ি ভাড়ার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন এই নম্বরে : ০১৯২৯৪১৭৪৪১