প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুমিল্লার চান্দিনার ঘুগরার বিল – হতে পারে পর্যটন কেন্দ্র
ওসমান গনিঃ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুমিল্লার চান্দিনার ঘুগরার বিল। যা স্থানীয় লোকজন ঘুরগার জলা বলেও ডাকে। যা দেশের প্রাচীনতম ইতিহাসের একটি উল্লেখ যোগ্য স্থান। ভৌগলিকগত ভাবে এ স্থানটির অবস্থান হলো চাঁদপুর জেলার কচুয়া আর কুমিল্লা জেলার চান্দিনা ও দাউদকান্দি উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে। ঘুগরার বিল বা ঘুগরার জলা নামটি শুনে অনেকের কাছে হয়ত একটু বিদখিটে মনে হতে পারে। কারন এ নামটি হয়ত কেউ কোনদিন শুনেন নি। তাছাড়া নামটি মনে রাখাও কষ্টকর হতে পারে। প্রথম প্রথম এমন মনে হলেও পরবর্তীতে অনেকের কাছে তা একবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এর নামকরণ নিয়ে তেমন কোন সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না। তবে বলা যায়, স্থানীয়দের ও আশেপাশের উপজেলার মানুষের মধ্যে এ ঘুগরার বিল – ঘুগরার জলা নামেই বেশ পরিচিত। স্থানীয় মানুষের নিকট এ বিল তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র মাধ্যম, বহিরাগতদের কাছে এটি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এক নয়নাভিরাম পর্যটন স্পট বা সাধারণের নিকট এটি শুধুই একটি বিল। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর বর্ষাকালীন সময়ে এ বিল তার সম্পূর্ণ রুপে তার নিজস্ব সৌন্দর্য বিকশিত করে। যা দেখে তার দিকে মানুষ আকৃষ্ট হয়। সাধারন লোকজন নয়ন ভরে এ সৌন্দর্যময় দৃশ্য দেখে প্রাণ জুড়ায় আর মুগ্ধ হয়। যা কেউ নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস ই করতে পারবে না। সত্যি ই এক অসাধারণ দৃশ্য।
এ সকল সৌন্দর্য উপভোগ করতে এ বছর ঈদের ছুটি ও করোনাকালীন অবসর সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনেকেই বহু দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ঘুগরার বিলের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আর তাই পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে এই অঞ্চল। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা আসছেন এখানে।কর্ম জীবনের ব্যস্ততা ছেড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছেন তারা।
আগত পর্যটকমহলের ছোট ছোট নৌকায় চড়তে দেখা যায়, কেউ কেউ নৌকায় বসে শাপলা তুলছেন আবার কেউ কেউ বিলের পানিতে নেমে আনন্দ উল্লাসে গা ভেজাচ্ছে হই হুল্লোর করছে। এ যেন জীবনে এক মহা আনন্দ পাওয়া। এ যেন ক্ষণিকের জন্য হলেও ছোট বেলায় হারিয়ে যাওয়ার মতো একটি সুন্দর মুহূর্ত।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি হেলিকপ্টারযোগে এ ঐতিহাসিক বিল সরেজমিন পরিদর্শন করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল দেশের প্রক্ষাপটে এ বিলের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই। কিন্তু, ৭৫’ এর নির্মম ঘটনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের আর কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। অথচ এটি হতে পারতো দেশের মানুষের জন্য এক আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট কিংবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। গড়ে উঠতো পাখি ও জলজ প্রাণীদের এক নিরাপদ আবাসস্থল। সরকারী-বেসরকারী মালিকানা মিলে এ উম্মুক্ত বিলের আয়তন প্রায় শত একরের কাছাকাছি।
এ বিল টি দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অভয়ারণ্য।
এ বিলে প্রায় ৫০-৬০ রকমের দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। আরো রয়েছে সাপ, ব্যাঙসহ বিবিধ প্রজাতির জলজ প্রাণী ও মৌসুমি পাখির অবাধ বিচরণ। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা লাল ও সাদা প্রজাতির শাপলা এ বিলের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। পানিতে নিমজ্জিত আছে বিভিন্ন প্রজাতির আকর্ষণীয় শৈবাল, কচুরিপানাসহ হরেক রকমের জলজ উদ্ভিদ। ভোরের দিগন্ত বিস্তৃত বিস্তীর্ণ জলরাশি ও ফুটন্ত শাপলার অপরুপতা সৌন্দর্য পিপাসুদের মনকে দোলা দিয়ে যায়। শুস্ক-বর্ষা মিলে বছরে দুবার এখানে ধানের ফলন হয়। তবে, সারা বছর জুড়ে মাছ ধরা এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম প্রধান পেশা। একমাত্র পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ডিঙ্গি নৌকার অবাধ বিচরন ঘুরতে আসা পর্যটকদের নজর কাড়বেই।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু লোভী ব্যক্তি/ভূমিখেকোর অবৈধ কর্মকান্ড এ বিলের স্থায়ী সৌন্দর্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তির অপরিকল্পিত আবাসন এ বিলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যকে ম্লান করছে। পাশাপাশি চলছে বাঁধ দিয়ে ব্যক্তিগত মৎস্যখামার নির্মাণ, অবৈধ বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার হিড়িক। এ অপকার্যসমূহ ঘুরগার বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও এর অখন্ডতাকে বহুলাংশে গ্রাস করছে। নষ্ট হচ্ছে এর প্রাগৈতিহাসিক জীববৈচিত্র্য। মানুষের অবাধ আনাগোনা ও নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ এ বিলের প্রাকৃতিক আধারকে বিনষ্ট করছে।
আশেপাশের অনেকগুলো খালের সাথে এ বিলের রয়েছে নিবিড় সংযোগ। একে কেন্দ্র করে নিরাপদ অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে পারলে ঘুরগার বিলের পূর্বের রূপ অনেকাংশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। দেশি প্রজাতির মাছের প্রজনন মৌসুমে প্রশাসন কর্তৃক কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ (প্রয়োজনে ঐ সময়ে মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি) করতে পারলে মাছের উৎপাদন বহুগুন বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি মানুষের অবাধ বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করলে বাড়বে মৌসুমি পাখির আনাগোনা। প্রাণ ফিরে পাবে এ বিস্তীর্ণ জলাধারের জলজ উদ্ভিদসমূহ। সরকারি-বেসরকারি মেগাপ্রজেক্ট গ্রহণের মাধ্যমে গড়ে তোলা যেতে পারে এতদঅঞ্চলের মানুষের বিনোদনের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। বাড়বে সরকারের রাজস্ব আদায়ও।
ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসন, চান্দিনা ও মৎস্য বিভাগ কর্তৃক এ বিলের সরকারি স্থানসমূহ পুনঃখননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সরকারিভাবে অবমুক্ত হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা। এতে বাড়বে মাছের উৎপাদন। অবৈধভাবে বসানো ড্রেজারসমূহ মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ধ্বংসসহ জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। অপরিকল্পিত আবাসন বন্ধ রাখতে স্থানীয়দের সচেতন করা হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ, অসাধু ব্যক্তিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা, জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ স্থানীয়দের বিকল্প কর্মসংস্থান বাড়াতে পারলে আবারো প্রাণ ফিরে পাবে জাতির পিতার অসমাপ্ত এ স্বপ্নের প্রকল্প। দল, মত নির্বিশেষে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় আবারো প্রাণ ফিরে আসুক ঘুরগার বিলের প্রাচীন সৌন্দর্যময় রুপ।
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট