বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা এগিয়ে নিতে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের বিকল্প নেই।

প্রকাশিত: ১০:২০ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২২

উমার রাযী, কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি-

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পকে আর অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। একথা এখন দিবালোকের মতো সত্য যে, বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটি অতি বড় মাপের শিল্প। আমাদের দেশে শিল্প বলতে এক সময় পাট শিল্পকে এবং বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্পকে বোঝানো হচ্ছে। পর্যটনও যে একটি বড় মাপের শিল্প হতে পারে তা আমাদের দেশের জনসাধারণ এখনো হয়তো জানেই না। বাংলাদেশে পর্যটনও হতে পারে জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। আমাদের রয়েছে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ। যার যথাযথ ব্যবহার আমাদেরকে পৌছে দিতে পারে সাফল্যের দ্বারে। এজন্য দরকার সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা । বাংলাদেশ যে একটি সুন্দর দেশ তা সবাইকে জানাতে হবে। পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে বাংলাদেশের দ্বার।

বাংলাদেশের অনেক মানুষ হয়তো জানেন না যে আমাদের কক্সবাজারের মতো বড় আর সুন্দর সি বিচ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এটি বেশ ঢালু আর প্রশস্ত। প্রাকৃতিক এ বিচ বিধাতার অপার দান। বেশীর ভাগ দেশের সি বিচ হয় খাড়া আর সংকীর্ণ। কিন্তু তারা তাই সাজিয়ে গুছিয়ে এমন সুন্দর করে রেখেছে যে পর্যটকরা দলে দলে ছুটে যায় সেই সব সমুদ্র উপকূলে। দুহাতে তারা খরচ করে টাকা। আয় হয় সে সব দেশের। মানুষের কর্মসংস্থান হয়। অর্থনীতি হয় শক্তিশালী।

অথচ আমাদের দেশে কখনো এদিকে নজর দেয়া হয়নি। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যে বিশাল প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত (সি বিচ) আছে তাকে সাজাতে পারলে ঝঁকে ঝাঁকে বিদেশী পর্যটক আমাদের দেশে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। পৃথিবীতে লাখ লাখ ভ্রমন বিলাসী লোক রয়েছেন যারা সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে ভালবাসেন। তাদেরকে বাংলাদেশে টেনে আনতে হবে।

বিশ্বের বহু দেশ তাদের দেশের দর্শনীয় স্থানসমূহের সদ্ব্যবহার করে পর্যটকদের কাছ থেকে আয় করছে কাড়ি কাড়ি টাকা। দেশের স্বার্থে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ঐসব দেশের মানুষ ও সরকার সম্মিলিতভাবে কাজ করে।

এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে, বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি বদ্বীপের দেশ। দেশটির প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের বিশেষ করে পর্যটকদের আকর্ষণ রয়েছে। তারা মুগ্ধ হয় এ দেশে ভ্রমণে আসে। এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিদেশি পর্যটকদের এতটাই মুগ্ধ করে যে, তাঁরা অতীতে ইবনে বতুতার সময় অথবা তারও আগে থেকে এ দেশের গুণগান করে তাদের ভাষায় ইতিহাস রচনা করেছেন। সত্যিকারার্থেই এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারি। তাই তো কবি বলেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি। অথচ, এমন দেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে আমাদের ব্যর্থতার শেষ নেই। পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে কোনো দেশ কিভাবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় মালদ্বীপ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ১১৯২টি দ্বীপ নিয়ে এই মালদ্বীপ। এর মধ্যে ২০০ দ্বীপে মানব বসতি আছে বাকি ৬০টি দ্বীপে নিদেনপক্ষে একটি করে হোটেল আছে এবং বাদ বাকিগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। মালদ্বীপ স্বপ্নময় ভূস্বর্গ বলে পর্যটকরা মনে করে।

মজার ব্যাপার হলো- দেশটির অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রায় সম্পূর্ণ পর্যটন শিল্পনির্ভর। মাত্র তিন লাখ অধিবাসী অধ্যুষিত মালদ্বীপের বেশিরভাগ বাসিন্দাই মুসলমান। দেশটির প্রায় ৯৯% এলাকা সমুদ্র। নিচু এলাকায় রয়েছে হাজারের অধিক প্রবাল দ্বীপ, এমন প্রবাল দ্বীপের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক বা দেড় মিটার ওপরে। যেহেতু দ্বীপরাষ্ট্র এ মালদ্বীপ তাই এটি রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সাথে যে কোনো সময় তলিয়ে যেতে পারে এ দ্বীপপুঞ্জ। গ্রিন হাউস এফেক্টের কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা বিরাজ করছে। এ আশঙ্কাকে সামনে নিয়েই চলছে মালদ্বীপের মানুষের অর্থনৈতিক সামাজিক কর্মকাণ্ড। দেশটির নিত্যসঙ্গী সুনামি। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে দেশটিতে ভয়াবহ সুনামির আঘাত হেনেছিল। এতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল ব্যাপক। তাই, পর্যটকের সংখ্যা দ্রুত কমে গিয়েছিল। সেই ধকল কাটিয়ে দেশটির লোকজন পর্যটন শিল্পের যারপরনাই উৎকর্ষ সাধন করে স্বাবলম্বী হয়েছে। পর্যটকরা মালদ্বীপ বাসীর সেবাতে দারুণভাবে মুগ্ধ। কোনো চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বা হাঙ্গামার খবর শোনা যায় না। তাই জাতীয় আয়ের বড় অংশের জোগান দেয় পর্যটন শিল্প। এভাবে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও যদি মালদ্বীপবাসী অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে তবে আমরা পারি না কেন? আন্তর্জাতিক মানের হোটেল মোটেলে অবস্থান করে মালদ্বীপের যেকোনো দ্বীপে যাতায়াত করা যায় সহজেই। বিধায় সেখানকার মানুষ সবাই কিছু না কিছু আয় করে। পর্যটন শিল্প মালদ্বীপবাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছে।

আমাদের দেশের উন্নয়নে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত হতে পারে আশীর্বাদ। এজন্য দেশি বিনিয়োগই শুধু নয়, প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা সরকারের উঁচু স্তর থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, পৃথিবীর বৃহত্তর প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার বাংলাদেশে অবস্থিত। তদুপরি রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। মালদ্বীপের ন্যায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা পাল্টে দিতে পারে। সুন্দরবন ও কক্সবাজার পর্যটন শিল্প বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্য, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনসমৃদ্ধ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের প্রচুর পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে। ফলে এখান থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারে। পর্যটন শিল্প হচ্ছে একটি বহুমাত্রিক এবং শ্রমঘন শিল্প। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজস্ব খাতে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে জায়গা করে নেয়াসহ ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে পূর্বের তুলনায় বিভিন্ন পর্যটক আকর্ষণীয় স্থানে ভ্রমণের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের একক বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। কক্সবাজার ও সুন্দরবনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক স্থান পর্যটক আগমন বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক গতিশীলতা আনয়নসহ দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এতে কোনো সংশয় নেই।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের বিকাশে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন সীমিত পর্যায়ে সাধ্যমত বিদেশে প্রচার-প্রচারণাও চালাচ্ছে বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রসমূহ আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য। আমাদের হোটেল-মোটেলগুলো আন্তর্জাতিক মানের এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার ঘাটতি নেই। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, প্রিন্ট মিডিয়া পর্যটন শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দেশি-বিদেশি ও ট্যুর অপারেটরদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করে বাংলাদেশের পর্যটন আকর্ষণ সমূহের দ্বার প্রতিনিয়ত উন্মোচন করার দিকটি ভাবতে হবে।

পর্যটন শিল্পকে আরো আকর্ষণীয়, প্রাণবন্ত করে গড়ে তুলতে সরকারকে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি বিনিয়োগকারী সংস্থার সাথে অংশীদারিত্বের সমঝোতা করে পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে হবে। মালদ্বীপের মতো দ্বীপ এবং নীল পানির নিচে আকর্ষণীয় জলজ সম্পদ না থাকলেও নয়নাভিরাম কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, নিঝুম দ্বীপ, মাধবকুণ্ড, জাফলংসহ সব পর্যটন কেন্দ্র বিদেশি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে আমরা যেমন অর্জন করতে পারবো বৈদেশিক মুদ্রা তেমনি আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত বেকার তরুণ খুঁজে পাবে কর্মসংস্থান। এ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে এ শিল্প বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনবে কাড়ি কাড়ি বৈদেশিক মুদ্রা। পর্যটনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আসা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং বেশি বেশি বিনিয়োগ করবেন। এ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। গাইড লাইন ও তদারকি। অর্থনীতির চাকা বেগবান হলে নানাভাবে আয় বাড়বে মানুষের, ঘুচে যাবে দারিদ্র্যের অভিশাপ, খুলে যাবে ভাগ্যের অপার সম্ভাবনার দ্বার। সে ক্ষেত্রে সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ে তুলতে কতক্ষণ।

মালদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাংলাদেশের চেয়ে সুন্দর কি-না তা বলা দুষ্কর। তবে আমাদের দেশের সৌন্দর্য আমাদেরই সর্বাগ্রে সুন্দর ও আকর্ষণীয় ভাবা শিখতে হবে। তবেই আমাদের দেখাদেখি বিদেশিরাও আসতে শুরু করবে। এভাবেই কোনো মহৎ কাজ গতি পায়। মনে রাখা দরকার যে, জড়সব ধিং হড়ঃ নঁরষঃ রহ ধ ফধু. তাই ঢাকায় বসে ফাইল চালাচালি করলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হবে না। প্রয়োজন দ্রুত বাস্তবায়ন ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ। কারণ, পর্যটনশিল্প জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল করতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে- এটুকু সবাইকে ভাবতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশে পর্যটন জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপ, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশ পর্যটন খাতে অনেক আয় করছে। পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন এখাতে পিছিয়ে থাকবে? বর্তমানে দেশে সকল ক্ষেত্রে চলছে সংস্কারের জোয়ার । বর্তমান সরকারের কাছে তাই আমার প্রত্যাশ্যা তারা পর্যটন খাতের দিকে নজর দেবেন।




error: Content is protected !!