হাফেজ মাওলানা মুফতি ওসমান আল উখিয়াভী
সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া বাইতুল কারীম, হালিশহর চট্টগ্রামঃ-
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর যথারীতি পবিত্র ঈদুল ফিতর সমাগত। রমজানের শেষে এই ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে; সারা বিশ্বের মুসলমান এটি পালন করেন একটি খুশির উৎসব হিসেবে। কিন্তু এ বছর যখন এই উৎসব এসেছে, তখন সারা পৃথিবী কোভিড–১৯ মহামারি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চল মিলে এই মহামারিতে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৩ লাখ ২৬ হাজার মানুষ; বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা ৪০০ পেরিয়েছে। উপরন্তু এই দুর্যোগের মধ্যেই আম্পান নামের এক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ২১ জন মানুষের মৃত্যুসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলা বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগমনে ঘরে ঘরে আনন্দ না হোক, আশা ও প্রত্যয় জাগুক যে আমরা সবাই মিলে এই দুর্যোগ ও দুঃসময় পেরিয়ে আবার সুস্থ, স্বাভাবিক, কর্মচঞ্চল জীবনে ফিরে যাব।
আল্লাহর কঠিনতম পরীক্ষার মধ্যদিয়ে দীর্ঘ এক মাস ধরে রোজা রেখে ইন্দ্রিয়ের কৃচ্ছ্রসাধনা শেষ হয়েছে।
ঈদুল ফিতর কি?
ঈদ,ফিতর’ শব্দ দুটি আরবি, যার অর্থ হচ্ছে উৎসব, আনন্দ, খুশি, রোজা ভেঙে ফেলা ইত্যাদি। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ শাওয়াল মাসের চাঁদের আগমনে রোজা ভেঙে আল্লাহর বিশেষ শোকরিয়া স্বরূপ যে আনন্দ-উৎসব পালন করেন- শরিয়তের পরিভাষায় তাই ঈদুল ফিতর।।
ঈদুল ফিতরের সূচনা:
হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, প্রতি বছর মুশরিকদের জন্য দু’টি দিন ছিল সেদিন তারা আনন্দ-উৎসব করত। রসুল (সা.) যখন মদিনায় আসেন তখন তিনি বলেন, তোমাদের ওই দুটি উৎসবের চেয়ে আরও উত্তম দুটি আনন্দের দিন দেওয়া হলো। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা।(সুনানে নাসায়ি : ১ম খ-, পৃ. ১৭৭; সুনানে আবু দাউদ ১ম খ-, পৃ. ১৬১,হাদীছ নম্বর-১১৩৬)।
ঈদের রাতের ফযীলত:
যে সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখা যায় সে রাতকে ঈদের রাত বলা হয়। এ রাতের অনেক গুরুত্ব ও ফযীলতের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি হাদীস নিম্নে তুলে ধরা হলো। ১। হযরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (স.) বলেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে আল্লাহর নিকট সাওয়াব প্রাপ্তির নিয়তে ইবাদত করবে তার হৃদয় সেদিনও জীবিত থাকবে যেদিন সকল হৃদয়ের মৃত্যু ঘটবে। (ইবন মাজাহ, হাদীস নম্বর ১৭৮২, আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নম্বর-১৫৯
ঈদুল ফিতরের সুন্নাত সমূহ:
(১) অতি প্রাত্যুষে ঘুম থেকে উঠা।
(২) মিসওয়াক করা।
(৩) ক্ষৌরকাজ সমাধা করা।
(৪) গোসল করা।
(৫) নিজের পোশাকসমূহের মধ্যে উত্তম পোশাক পরিধান করা।
(৬) সুগন্ধি ব্যবহার করা (পুরুষের জন্য)।
(৭) ঈদের নামাযের পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করা।
(৮) ঈদের নামাযের জন্য গমনের পূর্বে কিছু মিষ্টিদ্রব্য খাওয়া।
(১০) ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া।
(১১) এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা,
(১২) সকাল সকাল ঈদের নামায পড়ার জন্য যাওয়া।
(১৩) ঈদের নামায ঈদগাহে গিয়ে পড়া। (ঈদগাহ না থাকলে উজর বশত মহল্লার (এলাকার) মসজিদে ঈদের নামায পড়া যায়।)
(১৪) আস্তে আস্তে নিম্নলিখিত তাকবীর পড়তে পড়তে ঈদগাহে যাওয়া
(আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা– ইলা-হা
ইল্লাল্ল-হু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া
লিল্লাহিল হামদ)
(অর্থ : আল্লাহ সর্বমহান, আল্লাহ সর্বমহান, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আল্লাহ সর্ব মহান, আল্লাহ সর্ব মহান, আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা।
(১৫) শরীয়তের সীমার ভিতরে থেকে আনন্দ প্রকাশ করা ৷ উল্লেখ্য, পুরুষদের জন্য ঈদের নামায পড়া ওয়াজিব। মহিলাদের জন্য ঈদের নামায ওয়াজিব নয়। তাই পর্দার জন্য তাদের ঈদগাহে না যাওয়া বাঞ্ছনীয়। তারা ঘরে বসেই জিকির-আজকার ও তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করবেন।
ঈদের দিনের বর্জনীয় দিকসমূহ
১. জামাতের সাথে ফরজ সালাত আদায়ে অলসতা করা ২. ঈদের দিন সিয়াম পালন করা ৩. বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন করা ৪. নারী-পুরুষ একে অপরের বেশ ধারণ করা ৫. নারীদের খোলামেলা অবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হওয়া ৬. গান-বাজনা করা, অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখা ৭. অযথা কাজে সময় ব্যয় করা ৮. অপচয় ও অপব্যয় করা ৯. আতশবাজি করা ১০. ঈদের সালাত আদায় না করে কেবল আনন্দ-ফূর্তি করা ইত্যাদি। সাদাকাতুল ফিতর
ঈদুল ফিতরকে সর্বজনীন করে তুলতে ইসলাম সামর্থবানদের ওপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছে। কারণ ঈদের উপকরণ নতুন কাপড়, ভালো খাবার, সুগন্ধি ইত্যাদি যোগাড় করতে চাই টাকা। সমাজের দরিদ্র মানুষ যাদের দৈনন্দিন জীবনটা চলে অভাব আর বেদনায় জরাজীর্ণ অবস্থার মধ্য দিয়ে, তাদের পক্ষে আনন্দের উপকরণ যোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই ইসলাম সামর্থবানদের ওপর তাদের রোজার শোধক (ভুল-ত্রুটির পরিমার্জনা) হিসেবে সাদাকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করেছে।
আর এটাকে দরিদ্র মানুষের অধিকার হিসেকে ঘোষণা করেছে। যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অন্যের দয়া বা অনুগ্রহের অসহায় ভোক্তা হিসেবে হীনমন্যতায় ঈদ আনন্দে আত্মার অভিব্যক্তি হারিয়ে না ফেলে (সুনানে আবু দাউদ: ১৬০৯, সুনানে দারেমি: ২০৬৭, মুসদাতরেকে হাকেম: ১৪৮৮, আস্-সুনানুল কুবরা: ৭৬৯২, ফাযাইলুল আওকাত: ১৪৭, মারেফাতুস সুনান: ৮৪৩৮)
সালাতুল ঈদ:
ঈদ আনন্দের সর্বজনীনতার আর একটি বড় উপাদান হলো সালাতুল ঈদ।
ঈদের দিন প্রথম প্রহরে এলাকার সকল মানুষ উম্মুক্ত ময়দানে সমবেত হয়ে একই ইমামের পেছনে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছোট-বড়, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে দাঁড়িয়ে দু’রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে মানবিক ঐক্য আর সাম্য-মৈত্রীর যে মহিমা ফুটে ওঠে সত্যিই তা বড় আনন্দের! জতীয় উৎসবে সব কিছুর আগে সম্মিলিতভাবে খোলা মাঠে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নামাজ আদায়ের পবিত্র দৃশ্য মহান আল্লাহ খুবই ভালোবাসেন। তাইতো তিনি ঈদগাহে সমবেত মুসল্লিদের দেখিয়ে ফেরেশতাদের বলতে থাকেন, দেখো আমার ফেরেশতারা! আমার বান্দাগণ তাদের ওপর আমার বিধান (রমজান মাসের রোজা) পালন শেষে আমার বড়ত্ব বর্ণনা করতে করতে প্রার্থনার জন্য সমবেত হয়েছে।
বছর ঘুরে আসা ঈদুল ফিতরের দিনটি হোক সর্বজনীন উৎসবের দিন, বৈষয়িক আনন্দ পূর্ণ হোক খোদানুগত্যের নির্মল ধারায়। মুমিনের আনন্দ হোক বছর জোড়ে। ঈদ মোবারক।
লেখক : সম্পাদক, আলোর খেয়া, হেফাজত সমাচার।
(বহু গ্রন্থ প্রণেতা)