কে এম শাহীন রেজা কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি।।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে চারবার টাকা দিয়েও ১৩ বছরের ছেলের লাশ হাসপাতালের মর্গ থেকে বের করতে পারেননি হতভাগ্য এক ভ্যানচালক বাবা। সর্বশেষ দাবি করা ১০ হাজার টাকা দিতে না পারায় সারাদিন হাসপাতালের মর্গে লাশ আটকে রাখা হয়। ছেলের লাশের অপেক্ষায় দিনভর মর্গের সামনে বসে ছিল হতদারিদ্র সেই বাবা।
হৃদয় বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) বিকেলে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে। সারাদিন বসে থেকে ছেলের লাশ না পেয়ে শেষ বিকেলে মর্গের সামনে বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ভ্যানচালক কমল প্রমানিক।
বারবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে থাকেন, ‘আমি গরিব মানুষ, আমি টাকা কোথায় পাব। আমার এত টাকা দেওয়ার মতো কোনো সামর্থ্য নেই। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের সহযোগিতায় মোটা অংকের টাকা দাবি করেন মর্গের ডোম লক্ষণ ও হীরা লাল।’
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, দৌলতপুর উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের গাছিরদিয়া গ্রামের টলটলিপাড়ার হতদরিদ্র ভ্যানচালক কমল প্রমানিকের তের বছরের ছেলে শান্ত। কয়েক বছর মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছে। অভাব-অনটনের সংসারে পড়াশোনা ছেড়ে বর্তমানে কৃষি কাজ করত।
সোমবার (১২ জুলাই) সন্ধ্যায় মায়ের ওপর অভিমান করে নিজ বাড়িতে কীটনাশক পান করে শান্ত। রাত ৭টার দিকে পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে রাতেই কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে আসলে রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক শান্তকে মৃত ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে লাশ মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) বিকেল চারটায় লাশ কাটা মর্গের সামনে বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ভ্যানচালক কমল প্রমানিক। বারবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে থাকেন, ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে ওরা আমার ছেলের মরদেহ দেখিয়ে বলে, বুকের অর্ধেক কাটলে ৫ হাজার, পুরো কাটলে ১০ হাজার আর কপাল কাটতে আরও ছয় হাজার টাকা দেওয়া লাগবে। তা না হলে লাশ কাটা হবে না। ওদের বারবার বলেছি আমি গরিব মানুষ, আমার এত টাকা নেই। ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার চোখের সামনে ছেলের মরদেহ গরুর চামড়া ছেলার মতো চর চর করে ছিলে ফেলে।
তিনি বলেন, পুলিশের সামনে ডোমরা যখন টাকা দাবি করেন। তখন পুলিশ বলছে, এরা কি এসব বোঝে, তুমি এইটুকু কাটবা, এইটুকু কাটবা দেখাচ্ছ, এরা তো ওই সব বোঝে না। যে যেমন লোক, তার সঙ্গে সে রকম করো। আমি পুলিশ ভাইকে বারবার অনুরোধ করে বলেছি, ভাই আমি গরিব মানুষ। আমি ভ্যান চালিয়ে খাই। আমার টাকা দেওয়ার মতো কোনো অবস্থা নাই। আমি টাকা কোথায় পাব।
উল্টো পুলিশ আমাকে বলছে, এসব কথা এখানে চলবে না। আমি বারবার বলেছি, ভাই আমার দেওয়ার মতো কোনো ক্ষমতা নেই। আমার সহযোগিতা করার মতো লোকও নেই। আমার পাশে এসে দাঁড়াবে এমন একটা লোকও আমার নেই। ওরা আমার কোনো কথাই শোনেনি। তিনি আরও বলেন, সকাল থেকে এখন চারটা বাজে, আমার ছেলেকে এখনো নিয়ে যেতে পারিনি। ওরা বলছে টাকা ছাড়া আমার ছেলেকে দেবে না। আমি এখন টাকা কোথায় পাব। দশ হাজার টাকা দিয়ে লাশ নিয়ে যেতে বলছে। আমার কাছে তো টাকা নেই। ভাইগো আমার দশ হাজার টাকা দেওয়ার কোনো পরিবেশ নেই।
ভ্যানচালক কমল প্রমানিক অভিযোগ করে বলেন, রাতে লাশ মর্গে ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে লাশ পাহারা দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা দাবি করে দুইজন ডোম। আমি গরিব মানুষ, আমি টাকা কোথায় পাব, একথা বলতেই আমার ওপর রেগে উঠে। পরে আমার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা ধার করে ওদের দিয়ে রাতে বাড়ি চলে যাই। সকালে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার ৭০০ টাকা, পরে আরো একশ টাকা নেয়। দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেও বিভিন্ন খরচের কথা বলে আমার কাছ থেকে এক হাজার ৫৫০ টাকা নিয়ে নেয়।
শান্তর চাচা মামুন বলেন, সংবাদ শুনে দুপুরে আমি হাসপাতালের মর্গের সামনে এসে দেখতে পাই দুই ডোম ও একজন পুলিশ সদস্য এক টেবিলে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। পাশে শান্তর আব্বা দাঁড়িয়ে টাকা নিয়ে কথা বলছেন। এসময় আমি মোবাইলে ভিডিও করার চেষ্টা করলে তারা টের পেয়ে যায়। পরে আমাকে ভিডিও করতে দেয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে হাসপাতালের মর্গে কর্তব্যরত পুলিশ কনেস্টবল হাবিব জানান, তার সামনেই ডোমরা টাকা দাবি করেছে। আমি তাদের কোনো কিছু বলিনি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে হাসপাতালের মর্গের ডোম লক্ষণ জানান, তাদের কাছে কোনো টাকা দাবি করা হয়নি। তারা ইচ্ছে করে লাশ ফেলে রেখেছে।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এম এ মোমেন বলেন, এ ধরণের কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। অভিযোগ আসলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।