শীর্ষ চরমপন্থি নেতা লিপ্টনের বিরুদ্ধে এবার সংসদীয় কমিটিতে অভিযোগ
কে এম শাহীন রেজা, কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি
প্রায় দুই যুগ ধরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চার জেলায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শীর্ষ চরমপন্থি নেতা ও পুলিশের তালিকাভুক্ত কুষ্টিয়া জেলার মোস্ট ওয়ান্টেড ও হিট লিষ্টের দাগী সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর কবির লিপটন। হত্যা, মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ, টেন্ডারবাজি, চঁাদাবাজি ও অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকেই লিপটন নামটি এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তার ফোন পেলে ঠিকাদার, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের অনেকেরই ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। রাজধানীতেও নেটওয়ার্ক রয়েছে লিপটন বাহিনীর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাঘা বাঘা চরমপন্থি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও লিপটন আছে বহাল তবিয়তে। প্রথমে ভারতে পালিয়ে গিয়ে সেখানে বসেই আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করত। পরে সবকিছু ম্যানেজ করে দেশে ফিরে আবারও শুর“ করে সন্ত্রাসী তৎপরতা। লিপটন বাহিনীর অত্যাচার থেকে পরিত্রাণে এবার রাস্তায় নেমেছে চার জেলা কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের সাধারণ মানুষ। লিপটন ও তার বাহিনীর সদস্যদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ সমাবেশসহ হয়েছে নানা কর্মসূচিও। এতেও কাজ না হওয়ায় ভুক্তভোগীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও সন্ত্রাসী লিপটনের বিষয়ে খেঁাজখবর নিচ্ছে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শামসুল হক টুকু সমকালকে বলেন, সন্ত্রাসী লিপটনের ব্যাপারে অভিযোগ পেয়েছি। কমিটির আগামী সভায় এ নিয়ে আলোচনা হবে। এ সরকার সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমান সরকার সন্ত্রাসের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। সন্ত্রাসী যেই হোক তার বির“দ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কুষ্টিয়া জেলার একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে জানা গেছে লিপ্টন ও মামুন দু’জনই হিট লিষ্টেড তালিকাভুক্ত।কে এই লিপটন : জেলা পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী ও কুখ্যাত চরমপন্থি নেতা লিপটনের বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দুর্বাচারা গ্রামে। তার বাবার নাম আজিজুর রহমান। জামায়াত আদর্শের পরিবারে বড় হওয়া লিপটন নব্বইয়ের দশকে সরকারী কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে সাবেক অধ্যক্ষ মরহুম ইদ্রিস আলীর কপালে পিস্তল ধরে কলেজ ছাত্র সংসদ পদে সাধারন সম্পাদক পদ হাকিয়ে নেয়। তার পরই চরমপন্থি দল গণমুক্তিফৌজে নাম লেখায়। সে সময় নিজে হাতে একের পর এক হত্যা মিশন চালিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শুটার হিসেবে পরিচিতি পায়। একপর্যায়ে নিজেই বাহিনী গড়ে তোলে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া অভিযোগে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে জেলা বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা, তৎকালীন সংসদ সদস্যের ছত্র ছায়ায় টেন্ডারবাজি ও খুন-খারাবিতে মেতে ওঠে সে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জোরদার অভিযান শুর“ করলে লিপটন ভারতে পালিয়ে যায়। সেখানে অবস্থান করেই সে দেশে নানা অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছিল। এরপর অর্থের জোরে সবকিছু ম্যানেজ করে ২০১৩ সালে লিপটন দেশে ফিরে আবারও চরমপন্থি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেয়। অভিযোগ রয়েছে, লিপটন স্থানীয় র্যাবের কিছু সদস্যকে হাত করে নিজেকে এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত সোর্স পরিচয় দিয়ে থাকে।
যত সন্ত্রাসী কর্মকান্ড : প্রায় আড়াই যুগ ধরে সন্ত্রাসী জগতে তৎপর লিপটন। শুর“তে বিভিন্ন অপারেশনে কিলার হিসেবে কাজ করত। নিজে প্রায় দুই ডজন হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে অর্ধশতাধিক হত্যা মিশনের সঙ্গে তার সংশ্নিষ্টতা ছিল। অভিযোগ রয়েছে, ২০০২ সালে ঠিকাদারি কাজ নিয়ে বিরোধে বিএনপি নেতাদের ছত্রছায়ায় জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আক্তার“জ্জামান লাবুর ভাই জামাই বাবুকে গুলি করে হত্যা করে লিপটন ও তার তিন সহযোগী। যুবলীগ নেতা জামু ও ফয়েজ নামের আরও দুই ব্যবসায়ীকে ২০০৩ সালে লিপটনের নেতৃত্বে হত্যা করা হয়। ২০০৬ সালে থানাপাড়ার ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান হাবিবকে হত্যা করে লিপটন। এছাড়া তার নেতৃত্বে শহরে মাথা কেটে ফেলে রাখার মতো লোমহর্ষক ঘটনা এখনও কুষ্টিয়াবাসী ভোলেনি। এর বাইরেও ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরেও নানা অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছে লিপটন। এখনও তার কাছে প্রচুর অস্ত্র আছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে অস্ত্র এনে সে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে। এমনকি ওই অস্ত্রের চালান রাজধানীতেও আসে বলে অভিযোগ। এখনও নিয়মিত চঁাদাবাজি করে আসছে ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন থানায় তার বির“দ্ধে ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের শতাধিক জিডি রয়েছে।আওয়ামী লীগ নেতারাই টার্গেট : বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় লিপটন বেছে বেছে আওয়ামী লীগ নেতা ও এই দলের অনুসারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই বেশি চঁাদা আদায় করেছে। চঁাদা না দিলে তারাই বেশি অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন। জামাই বাবু, জামুসহ আওয়ামী লীগ-যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতা সে সময় খুন হন। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তবে কিছুটা কৌশল বদলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সদর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল আলিম, কাঞ্চনপুর যুবলীগের আহ্বায়ক রাশিদুল ইসলাম, সাবেক নেতা হাবিবর রহমান ও ইমনকে অস্ত্র দিয়ে ফঁাসিয়ে দেওয়া হয়। এসব ঘটনার প্রতিবাদে এলাকার হাজার হাজার সাধারণ নারী-পুর“ষ বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করে লিপটনের গ্রেপ্তারের দাবি জানায়।
লিপটন বাহিনীতে যারা : সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, লিপটনের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করে ভাদালিয়া দরবেশপুর গ্রামের আলী মহম্মদের ছেলে মামুন অর রশিদ ওরফে টাইগার মামুন। মামুনের বাহিনীতে ‘হিটার’ হিসেবে আছে সাতজনের একটি দল। তার ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী আত্মীয় স্বাধীনতা বিরোধী আনিসুর রহমান ঝন্টু ছাড়াও গোলাম সরোয়ার, হবিবার রহমানসহ বিএনপি-জামায়াতের বেশ কয়েকজন নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। বাইরন নামে প্রশাসনের এক কর্মকর্তা তার ভাই হওয়ার সুবাদে লিপটন তার নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। লিপ্টনের বড় ভাই মিল্টন সেী বর্তমানে দুর্বচারা গ্রামের বাড়ীতে অবস্থান করে সেখানেও সে লিপটনের কথা মত চঁাদাবাজী, অপহরন, টেন্ডারবাজীসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে। তবে এটাও জানা গেছে চরমপন্থী লিপ্টন ও টাইগার মামুন অচিরেই গ্রেফতার হবে বলে প্রশাসনের একটি সুত্র জানিয়েছেন।