হাফেজ মাওলানা আয়াজ উদ্দীন:
পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে এ দিনে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও উপহার বিনিময় হয়। উপহার সামগ্রীর মধ্যে আছে পত্র বিনিময়, খাদ্যদ্রব্য, ফুল, বই, ছবি, প্রেমের কবিতা, গান, শ্লোক লেখা কার্ড প্রভৃতি। গ্রীটিং কার্ডে, উৎসব স্থলে অথবা অন্য স্থানে প্রেমদেব (ঈঁঢ়রফ)-এর ছবি বা মূর্তি স্থাপিত হয়। সেটা হল একটি ডানাওয়ালা শিশু, তার হাতে ধনুক এবং সে প্রেমিকার হৃদয়ের প্রতি তীর নিশান লাগিয়ে আছে। এ দিন স্কুলের ছাত্ররাও তাদের ক্লাসরুম সাজায় এবং অনুষ্ঠান করে।
এ দিন পালিত বিচিত্র অনুষ্ঠানাদির মধ্যে একটি হচ্ছে দু’জন শক্তিশালী পেশিবহুল যুবক গায়ে কুকুর ও ভেড়ার রক্ত মাখত। অতঃপর দুধ দিয়ে তা ধুয়ে ফেলার পর এ দু’জনকে সামনে নিয়ে বের করা হ’ত দীর্ঘ পদযাত্রা। এ দু’যুবকের হাতে চাবুক থাকত যা দিয়ে তারা পদযাত্রার সামনে দিয়ে অতিক্রমকারীকে আঘাত করত। রোমক রমণীদের মাঝে কুসংস্কার ছিল যে, তারা যদি এ চাবুকের আঘাত গ্রহণ করে তবে তারা বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পাবে। এ উদ্দেশ্যে তারা এ মিছিলের সামনে দিয়ে যাতায়াত করত। ১৮শ’ শতাব্দী থেকেই শুরু হয়েছে ছাপানো কার্ড প্রেরণ। এসব কার্ডে ভাল-মন্দ কথা, ভয়-ভীতি আর হতাশার কথাও থাকত। ১৮শ’ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যেসব কার্ড ভ্যালেন্টাইন ডেতে বিনিময় হত তাতে অপমানজনক কবিতাও থাকত।সবচেয়ে যে জঘন্য কাজ এ দিনে করা হয় তা হল ১৪ ফেব্রুয়ারি মিলনাকাঙ্ক্ষী অসংখ্য যুগলের সবচেয়ে বেশী সময় চুম্বনাবদ্ধ হয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। আবার কোথাও কোথাও চুম্বনাবদ্ধ হয়ে ৫ মিনিট অতিবাহিত করে ঐ দিনের অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকে। ভালবাসায় মাতোয়ারা থাকে ভালবাসা দিবসে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো। পার্ক, রেস্তোরাঁ, ভার্সিটির করিডোর, টিএসসি, ওয়াটার ফ্রন্ট, ঢাবির চারুকলার বকুলতলা, আশুলিয়া- সর্বত্র থাকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের তুমুল ভিড়। ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে’ উপলক্ষে অনেক তরুণ দম্পতিও হাজির হয় প্রেমকুঞ্জগুলোতে।ভ্যালেন্টাইনস ডে কখন থেকে :
ভ্যালেন্টাইনস ডে’র ইতিহাস প্রাচীন। এর সূচনা প্রায় ১৭শ’ বছর আগের পৌত্তলিক রোমকদের মাঝে প্রচলিত ‘আধ্যাত্মিক ভালবাসা’র মধ্য দিয়ে। এর সাথে কিছু কল্পকাহিনী জড়িত ছিল, যা পরবর্তীতে রোমীয় খ্রিস্টানদের মাঝেও প্রচলিত হয়। ভ্যালেনটাইন ডে সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন- ১. রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস-এর আমলের ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেনটাইন সম্রাটের খ্রিস্টধর্ম ত্যাগের আহবান প্রত্যাখ্যান করলে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়। ২. ১৪ ফেব্রুয়ারি রোমকদের লেসিয়াস দেবীর পবিত্র দিন। এদিন তিনি দু’টি শিশুকে দুধ পান করিয়েছিলেন। যারা পরবর্তীতে রোম নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিল। ৩. ১৪ ফেব্রুয়ারি রোমানদের বিবাহ দেবী ‘ইউনু’-এর বিবাহের পবিত্র দিন। ৪. রোম সম্রাট ক্লডিয়াস তার বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করতে গিয়ে যখন এতে বিবাহিত পুরুষদের অনাসক্ত দেখেন, তখন তিনি পুরুষদের জন্য বিবাহ নিষিদ্ধ করে ফরমান জারি করেন। কিন্তু জনৈক রোমান বিশপ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এটাকে প্রত্যাখ্যান করেন ও গোপনে বিয়ে করেন। সম্রাটের কানে এ সংবাদ গেলে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। সেদিন থেকে দিনটি ভালবাসা দিবস হিসাবে কিংবা এ ধর্মযাজকের নামানুসারে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব-
১৯৯৩ সালের দিকে বাংলাদেশে বিশ্ব ভালবাসা দিবসের আর্বিভাব ঘঠে। যায় যায় দিন পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমান। তিনি পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে। পাশ্চাত্যের ছোঁয়া নিয়ে দেশে এসে লন্ডনী সংস্কৃতির প্র্যাকটিস শুরু করেন। তিনি প্রথম যায় যায় দিন পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্ব ভালবাসা দিবস বাংলাদেশীদের কাছে তুলে ধরেন। তেজগাঁওয়ে তার পত্রিকা অফিসে কেউ চাকরী নিতে গেলে না কি সাথে তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে যেতে হতো। প্রেমের যুগললবন্দী কপোত-কপোতীকে দেখে ওনি না কি খুব খুশী হতেন। অভিধা প্রথম ব্যবহার করেন শফিক রেহমান। এজন্য শফিক রেহমানকে বাংলাদেশে ভালবাসা দিবসের জনক বলা হয়।আজ মুসলিম বিশ্বের বহু স্থানে ঠিক এটাই ঘটছে, মুসলিমরা তাদের চালচলন, রীতিনীতি এবং উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রে ইহুদী ও খ্রীস্টানদের অনুসরণ করছে ৷ টিভি, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেটের মত মিডিয়ার প্রচারে কাফিরদের অনুসৃত সমস্ত রীতিনীতি আজ মুসলিমদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচেছ এবং এর অনুসরণ ও অনুকরণ সহজতর হয়ে উঠেছে ৷ মুসলিম সমাজে প্রচলিত এরূপ বহু অপসংস্কৃতির সাথে একটি সাম্প্রতিক সংযোজন হচেছ “ভ্যালেন্টাইন’স ডে”, যা “ভালবাসা দিবস” নামে বাঙালী মুসলিম সমাজের যুবক-যুবতীদের মাঝে ঢুকে পড়েছে এবং ক্রমে জনপ্রিয়তা লাভ করছে, পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এ দিবসটি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে ৷ এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামের আলোকে এই ভালবাসা দিবসকে মূল্যায়ন করে বাঙালী মুসলিম সমাজের মুসলিম যুবক-যুবতীদের বোধশক্তি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তাদেরকে কাফিরদের অন্ধ অনুসরণ থেকে নিবৃত্ত করা ৷ নিশ্চয়ই ইহুদী ও খ্রীস্টানসহ অন্যান্য কাফিরদের সংস্কৃতির অনুসরণের পরিসমাপ্তি ঘটবে জাহান্নামের আগুনে, তাই বর্তমান নিবন্ধের উদ্দেশ্য আমাদের যুবসম্প্রদায়কে জাহান্নামের পথ থেকে ফিরিয়ে জান্নাতের প্রশান্তির দিকে আহবান করা ৷
লেখক : ইসলামিক প্রাবন্ধিক ও তরুন আলেম।