মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কুরমা বনবিট এলাকায় নৈসর্গিক হামহাম জলপ্রপাত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের কাছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান। ধারণা করা হয় এই জলপ্রপাতটির উচ্চতা ১৩৫-১৬০ ফুটের মধ্যে।
দুর্গম জঙ্গলে ঘেরা জলপ্রপাতটি দেখতে গিয়ে অনেক সময় পথ হারিয়ে ফেলেন অনেকে। উপরন্তু, পাশেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত, তাই পথ হারিয়ে নো ম্যানস ল্যান্ড বা অন্য দেশে অনুপ্রবেশের সম্ভাবনাও থাকে। এছাড়া, হামহামের নৈসর্গিক দৃশ্যে মোহিত হয়ে অনেকে ফেরার কথা ভুলে যান। তখন সন্ধ্যা নেমে গেলে সেখানকার ঘনায়মান অন্ধকার, ওপর থেকে ঝরনার পানি পড়ার শব্দ ও বনের পশু-পাখির বিচিত্র আওয়াজে ভয়ও পান অনেকে। গহিন পাহাড় এবং ঝিরি পথের পিচ্ছিল রাস্তায় একটু বেখেয়াল হলেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।
তবে, হামহাম ঝরনা দেখতে যাওয়া সৌন্দর্য পিয়াসি নিসর্গ প্রিয় পর্যটকদের এই সব প্রতিকূলতায় ‘হামিকে’ পাওয়া যাবে গাইড হিসেবে। বন থেকে বের হয়ে লোকালয়ে আশা পর্যন্ত হামি আপনাকে পথ দেখাবে। কখনো সামনে থেকে, কখনো পেছনে থেকে আগলে নিয়ে আসে পর্যটকদের। পাহাড়ি পথ বা ঝিরি দুটিতেই সে সমান তালে পর্যটকের পাশে গায়ে গায়ে মিশে হাটে। ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় সে বিকল্প পথে দেখাবে। বিকল্প পথে যেতে চিৎকার করে ডাকবে।
‘হামি’ একটি কুকুর। হামহাম ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের প্রিয় বন্ধু সে। তবে তখনই এই বন্ধুর দেখা পাওয়া যায়, যখন হামহামে সন্ধ্যা নামে বা বনে কেউ পথ হারিয়ে ফেলে। আর যদি আপনার সঙ্গে গাইড না থাকে, তাহলে বুঝবেন কুকুরটিই আপনার গাইড। হামহাম ঝরনায় সর্বশেষ একজন পর্যটক থাকলেও ‘হামি’ ফিরবে না। যখন শেষ পর্যটক হামহাম থেকে চলে আসবেন তখন হামিও লোকালয়ের পথে হাঁটবে।
স্থানীয় গাইড ও এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, হামি নামের এই কুকুরটি প্রায় ২ বছর ধরে পর্যটকদের সঙ্গে প্রতিদিন সকালে হামহাম জলপ্রপাতে যায়। সেখানে সারা দিন সে থাকে। পর্যটকদের দেয়া বিভিন্ন খাবার খায়। তার সঙ্গে আরেকটি কুকুর আছে ‘মামি’ নামের। তবে হামিই দুরন্ত ও দায়িত্বশীল। যতক্ষণ সেখানে পর্যটক থাকবেন ততক্ষণ হামি সেখানে থাকবে।
হামহামের নিকটবর্তী গ্রামের বাসিন্দা ও গাইড নারায়ণ নুনিয়া জানায়, এই কুকুর তাদেরই গ্রামে বেড়ে উঠেছে। সে প্রতিদিন সকালে যে প্রথম হামহামের রাস্তায় পা ফেলে তার সঙ্গে চলে যায় জলপ্রপাতে। আর দিন শেষে সব শেষে যারা হামহাম থেকে ফিরে আসেন তাদের সঙ্গে আসে। এই কুকুর কারও সঙ্গে থাকলে এই বনে চলতে গেলে তাদের আর গাইড লাগে না।
সম্প্রতি স্থানীয় সংবাদকর্মী মাহমুদ এইচ খান ঢাকা থেকে আসা একটি পর্যটক দলের সঙ্গে হামহাম গিয়ে ফিরতি পথে দেরি করে ফেলায় হামির সহায়তায় লোকালয়ে ফিরে আসে।
মাহমুদ এইচ খান জানান, আমাদের ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে যায়। ওই পরিবেশে বনের ভেতর একটু ভয়ও করছিল। সেসময় লক্ষ্য করি একটি কুকুর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। সে এতোই সূক্ষ্মভাবে আমাদের গাইড করেছিল যা অবাক করার মতো। পুরোটা রাস্তা সে আমাদের সঙ্গে ছিল। আমরা রাতের অন্ধকারে রাস্তায় আধা ঘণ্টার বিরতি দিয়েছি, আমাদের সঙ্গে সে বিশ্রাম করেছে, কিন্তু আমাদের ছেড়ে যায়নি। তারপর আমাদের সঙ্গে সে লোকালয়ে আসে। ভেবেছিলাম তাকে খাবার দিয়েছিলাম সে জন্য সে সঙ্গে আছে, পরে শুনলাম এই কুকুর এমনই। এর আগে আমাদের আরও বন্ধুদের সঙ্গে হামহামে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে লোকালয়ে খোঁজ নিয়ে হামির এই কাজ সম্পর্কে জানতে পারি। যখন সে আমাদের সাহায্য করে তখন ঠিক চিনতাম না কুকুরটিকে। তবে লোকালয়ে ফিরে স্থানীয়দের কুকুরটির কথা বলতেই জানতে পারি তার নাম ‘হামি’।
সম্প্রতি হামহাম ঘুরে এসেছেন ডেনমার্কের নাগরিক টিকলু ও বিমান ধর। তারা জানান, রাস্তায় সে আমাদের সঙ্গে শুধুই ছিল এমনটা বললে ভুল হবে। সে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় সে আমাদের বিকল্প রাস্তায় চলতে দেখিয়েছে। বন্যপ্রাণীদের নড়াচড়া পেলে সে পেছনে চলে গেছে যাতে আমাদের ওপর কোনো প্রাণী আক্রমণ করলে সে ঠেকাতে পারে। হামহামের কথা ভুলে গেলেও এই কুকুরটি কথা ভুলব না।