মো জামাল হোসেন লিটনঃ নমুনা পরীক্ষার নামে জালজালিয়াতির অভিযোগ তদন্তে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবার সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ও তার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীকে মুখোমুখি করেছে। এ সময় আরিফকে দেখেই সাবরিনা চিৎকার করে ওঠেন। তার দিকে খেপে গিয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন। আরিফকে উদ্দেশ করে বলেন- ‘তোর জন্যই আজ আমার এই অবস্থা। তুই আমাকে শেষ করে দিয়েছিস। সবকিছু করে এখন আমাকে ফাঁসিয়েছিস।’ আরিফও পাল্টা জবাবে বলেন, ‘সব দোষ কি আমার? তুমি তো এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলে। তুমিও জানতে সবকিছু।’
বুধবার (১৫ জুলাই) সন্ধ্যায় রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে এভাবেই দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ চলে বাকবিতন্ডা। গ্রেফতারের পর থেকে নিজেকে জেকেজির চেয়ারম্যান হিসেবে অস্বীকার করতে থাকলেও আরিফের মুখোমুখি হয়ে সে বিষয়ে বুধবার চুপসে যান সাবরিনা। আরিফ তাকে অভিযুক্ত করে জেকেজির নানা কর্মকান্ডে সম্পৃক্ততা ফাঁস করতে থাকলে ডা. সাবরিনার আর কিছুই বলার থাকে না। এক পর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকেন।
জেকেজি বাসা থেকে সংগ্রহ করা করোনা পরীক্ষার নমুনা স্বাস্থ্য অধিদফতরে পাঠাত না। সংগ্রহ করা নমুনা ড্রেনে ও ওয়াশ রুমে ফেলে তা নষ্ট করে ফেলা হতো। আদালতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীর দেওয়া জবানবন্দিতে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেফতারের পর আরিফ চৌধুরী দোষ চাপিয়েছেন স্ত্রী সাবরিনাসহ প্রতিষ্ঠানের চারজনের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে সাবরিনা বলেছেন, যা কিছু ঘটেছে তার দায় স্বামীর। তিনি জালজালিয়াতির বিষয়গুলো বুঝতে পারেননি। জেকেজিতে অপরাধ হয়েছে, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। কার দায় কতটুকু তা নির্ধারণে দুজনকে মুখোমুখি করা হয়েছে।
আগের মতো রিমান্ডেও সাবরিনা জেকেজি’র সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন। যদিও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জেকেজি’র সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে এমন ডজনখানেক প্রমাণ পেয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা তদন্ত কর্মকর্তাদের অধিকাংশ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারছেন না। কিছু প্রশ্নের অগোছালো উত্তর দিচ্ছেন। তবে গোয়েন্দারা ইতিমধ্যে সাবরিনা ও তার স্বামীর নানা অনৈতিক কাজের তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন। তাদের সহযোগী হিসেবে আর কে কে আছেন এসব বিষয়ে তথ্য পেয়েছেন।তাই শিগগিরই তাদের সহযোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যারা ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে সহযোগিতা করেছেন তাদের মধ্যে কয়েকজন সিনিয়র চিকিৎসক রয়েছেন। তারা ক্ষমতাসীন দলের হয়ে চিকিৎসকদের সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসব চিকিৎসক ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। চিকিৎসকদের সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে তারা আছেন। তাদেরকে ব্যবহার করে সাবরিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সহ আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তার করে কাজ আদায় করে নিয়েছেন। এই চিকিৎসকদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাদের একজন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান মিলন। তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ডা. কামরুলের বিষয়ে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সাবরিনার সঙ্গে কামরুলের সম্পর্কের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। সহকর্মী ও চিকিৎসক সংগঠন থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন। কামরুলের সহযোগিতা নিয়েই সাবরিনা বিএমএ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ পেয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। সাবরিনা প্রথমদিকে ডা. কামরুলের বিষয়ে মুখ না খুললেও নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে কামরুলের সংশ্লিষ্টতার তথ্য দিচ্ছেন। তাই তার তথ্যের ভিত্তিতেই ডা. কামরুলকেও জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরো তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
কামরুল ছাড়াও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ডা. সাবরিনার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। এই বান্ধবীর সঙ্গে তাকে প্রায়ই দেখা যেত। রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন পার্টি, অনুষ্ঠান, মন্ত্রণালয়ে একসঙ্গে তাদের উপস্থিতি ছিল। বান্ধবীর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। এক পোশাক ব্যবসায়ীর স্ত্রী তিনি। গোয়েন্দারা সাবরিনার বান্ধবীর বিষয়ে বেশকিছু তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তিনি একাধিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। নিজেকে তিনি ব্যবসায়ী ও এফবিসিআই’র পরিচালক হিসেবেও পরিচয় দেন। একটি আইপি টেলিভিশনের (অনুমোদনহীন) মালিক বলেও তার পরিচিতি আছে। এই টিভির পরিচয়পত্র বিক্রি করে তিনি টাকা কামান। টিভি চ্যানেলের মালিক পরিচয় দিয়ে তিনি বিভিন্ন স্থানে প্রভাব বিস্তার করেন। মানুষকে হুমকি-ধামকি দেন। সচিবালয়ে রয়েছে তার অবাধ যাতায়াত। কিছুদিন আগে আরেক বেসরকারি টেলিভিশন মালিকের সঙ্গে গান করার কথা বলে ও ইফতার পার্টিতে সিনেমার গান করে দেশ-বিদেশে আলোচিত হয়েছেন।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এই বান্ধবীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের চেনাজানা যেমন রয়েছে তেমনি তারা ঘনিষ্ঠও। ধানমণ্ডির একটি রেস্টুরেন্টে তাদের যাতায়াত ছিল নিয়মিত। সেখানে নিয়মিত পার্টি হতো। পরিবেশন করা হতো বিদেশি পানীয়। পার্টিতে অংশগ্রহণ করতেন আরো অনেক নারী। সূত্রমতে, সাবরিনা তার মাধ্যমে অনেক সুবিধা নিয়েছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই বান্ধবীর বিষয়ে আরো বিস্তর তথ্য নিচ্ছেন। সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফের প্রতারণার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা সেটি দেখা হচ্ছে। যদি কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় তবে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এ ছাড়া সাবরিনার মোবাইল ফোনের কললিস্টে অনেক চিকিৎসক নেতা থেকে শুরু করে সরকারদলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী, বর্তমান এমপি, সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক নেতা সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সাবরিনা গ্রেপ্তারের পর থেকে এদের প্রত্যেকেই এখন আতঙ্কে আছেন। রিমান্ডে সাবরিনা যদি তাদের বিষয়ে তথ্য দেন এবং তদন্তে সাবরিনার প্রতারণার সঙ্গে যদি তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় তবে তারাও ফেঁসে যেতে পারেন।
সনদ জালিয়াতির ঘটনার পাশাপাশি সাবরিনার নানা কেলেঙ্কারির তথ্য বেরিয়ে আসছে একের পর এক। একাধ