কুষ্টিয়ায় আহম্মেদ গং কর্তৃক সরকারী ভবন দখলের প্রাক্কালে ৩ সাংবাদিক লাঞ্চিত ও লুট, থানায় এজাহার দায়ের
কে এম শাহীন রেজা, কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি ॥
কুষ্টিয়া শহরের প্রানকেন্দ্র বড় বাজারের মধ্যে হাইকোর্টের সিভিল রিভিশন ২৬৩৮/২০১৮ নং মোকদ্দমায় নালিশী জমির উপর নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকা অবস্থায় আহম্মেদ আলী ও তার স্ত্রী রেহেনা আহম্মেদ সরকারি সম্পত্তি জাল দলিল করে অবৈধভাবে পুরাতন ভবন ভেঙ্গে মূল্যবান লোহার বীম ও আকার আকৃতি পরিবর্তন করার বিষয়টি গত ১০ অক্টোবর দুপুরে সাংবাদিকদের নজরে আসলে তাৎক্ষনিক ভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তিন জন সাংবাদিককে বেদম প্রহার করে। সেই সাথে তাদের কাছে থাকা ক্যামেরা, স্বর্নের চেইন ও আংটি জোরপূর্বক কেড়ে নেয়। এ বিষয়ে সাংবাদিক আমিন হাসান বাদী হয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় গত ১০ অক্টোবর আহম্মেদ আলী ও তার তিন পুত্র, শিমুল, মানিক ও রতনের নামে একটি এজাহার দায়ের করেন।
বিষয়টি নিয়ে গত ৩০ আগষ্ট কুষ্টিয়া সদর পৌর ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের নিকট আহম্মেদ আলী ও তার স্ত্রী রেহেনা আহম্মেদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য পত্র প্রেরন করেন, যার স্বারক নং-পৌরঃভূঃঅ/কুষ-সদর/২০২২-১২৪। স্বারক পত্র মতে জানা যায়, ১৯২২ সালে সিএস মোতাবেক সম্পত্তির প্রথম মালিক ছিলেন হরদেবদাস আগরওয়ালা ও সুখদেবদাস আগরওয়ালা। তারপর ১৯৬২ সালে এসএ মোতাবেক সম্পত্তির দ্বিতীয় মালিক হন আব্দুল লতিফ আনসারী ও মুহাম্মদ নজির আনসারী। পরে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সম্পত্তির মূল মালিক আর না থাকায় সম্পত্তিটি বাংলাদেশ সরকার পক্ষে পূর্ত ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয় নামে রেকর্ড চূড়ান্ত হয়। পরে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় পরিত্যক্ত সম্পত্তি শাখা হতে ৭৯/৩/-৭১-৭২ নং কেসে দোকান (বাণিজ্যিক) হিসেবে শহরের আমলাপাড়া এলাকার হাকিম উদ্দিনের ছেলে আহাম্মদ আলী, আড়ুয়াপাড়া এলাকার আতিয়ার রহমানের ছেলে মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন ও হরিপুর কান্তিনগর এলাকার মৃত উকিল উদ্দিনের স্ত্রী মোছাঃ রিজিয়া বেগমের এর অনুকলে ইজারা প্রদান করা হয়।
জমিটি সরকারের অতি মূল্যবান সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টায় আহম্মেদ আলী তার স্ত্রী মোছাঃ রেহেনা আহম্মেদের নামে একটি বানোয়াট বায়না নামা জাল দলিল সৃষ্টি করে সম্পত্তি রেজিষ্টার করে রেজিস্ত্রী মূলে প্রাপ্তির জন্য বিজ্ঞ দেওয়ানী আদালতে ১৮৬/৮৭ নং মোকদ্দমা দায়ের করেন। আহম্মেদ আলী সরকারী মূল্যবান সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য অভিনব কৌশলের মাধ্যমে উক্ত মোকদ্দমায় খতিয়ান নম্বরটি ১৭৪ এর স্থলে ১৭৪৯ আরজিতে উল্লেখ করেন। ১৭৪৯ নং খতিয়ানভূক্ত জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি হওয়ায় উক্ত মোকদ্দমায় রাষ্ট্রপক্ষ কোন প্রতিদ্বন্দিতা না করায় বিজ্ঞ আদালতকে ভুল বুঝিয়ে তিনি একটি এক তরফাসূত্রে রায় হাসিল করেন।
রায় ডিক্রীর বুনিয়াদে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিষ্ট্রী অফিস হতে গত ০৩/০১/২০১৫ ইং তারিখে ১০৮৪/২০১৫ নং একটি খোষকবলা দলিল সম্পাদন করেন। সরকারী সম্পত্তি আত্মসাতের পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি গত ০৩/০১/২০১৫ ইং তারিখে মূল মোকদ্দমার খতিয়ান নম্বর সংশোধনের জন্য দেঃ কাঃ বি আইনের ১৫১, ১৫২ ও ১৫৩ ধারার বিধানমতে আবেদন করেন। উল্লেখিত দলিলের বুনিয়াদে বিজ্ঞ কুষ্টিয়া জেলা জজ আদালতে ০১/০৩ নং দায়ের করলে বিজ্ঞ আদালত মামলাটি বিচারের জন্য মিরপুর সহকারী কুষ্টিয়া আদালতে স্থানান্তর করলে মিরপুর সহকারী জজ কুষ্টিয়া আদালতে ০২/০৩ নং জারী মোকদ্দমায় বিচার কার্য পরিচালিত হয়।
মোকদ্দমায় রাষ্ট্রপক্ষকে কোন রকম জ্ঞাত না করে যোগসাজসীর মাধ্যমে প্রতিপক্ষ এক তরফা সূত্রে রায়-ডিক্রী হাসিল করেন। উক্ত জারী মোকদ্দমার ডিক্রী মোতাবেক তিনি বিজ্ঞ আদালতের সহায়তায় দখল গ্রহন করেন। সে সময় এই জালিয়াতির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলে অবগত হয়। তাৎক্ষণিক ভাবে রাষ্ট্রপক্ষ বাদী হয়ে বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের দেং ১৮৬/৯৭ নং মোকদ্দমার ০৪/৮/২০০২ ইং তারিখের রায় ও ০৭/০৮/২০০২ ইং তারিখের ডিক্রী, তবুনিয়াদে মিরপুর সহকারী জজ আদালতের দেং জারী ০২/০৩ নং মোকদ্দমার রায় ও ০৩/০২/২০১৫ ইং তারিখের ১০৮৪/২০১৫ নং রেজিষ্ট্রীকৃত দলিল সম্পুর্ন বে-আইনী, পন্ড, ভুয়া, যোগসাজসী এবং উক্ত বে-আইনী রায় ডিক্রী সরকারের উপর বাধ্যকর নয় মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে দেং ১০১/২০১৬ নং মোকদ্দমা দায়ের করলে বিজ্ঞ আদালত মিরপুর সহকারী জজ আদালতের দেং জারী ০২/০৩ নং মোকদ্দমার যাবতীয় কার্যক্রম স্থগিত করেন।
এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টে ২৬৩৮/২০১৮ নং সিভিল রিভিশন মোকদ্দমা দায়ের করেন। একই সাথে হাইকোর্ট গত ০৬/৮/২০০৮ ইং তারিখের আদেশে বিচারিক আদালতের দেং জারী ০২/০৩ নং মোকদ্দমার আদেশ স্থগিত করেন। বিচারিক আদালতের দেং জারী ০২/০৩ নং মোকদ্দমার আদেশ স্থগিত হওয়ায় নালিশী জমিতে আহম্মেদের স্ত্রীর সম্পত্তির কোন দাবীদার থাকেনা। সাথে বে-আইনী ভাবে নালিশী জমির উপর পুরাতন ভবনের ছাদ ভেঙ্গে মুল্যবান লোহার বীম বিক্রি করেছে এবং তিনি নালিশী জমির আকার-আকৃতি পরিবর্তন করেছে মর্মে জেলা প্রশাসকের নিকট আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহনের জন্য জানান।
এ বিষয়ে উক্ত সাংবাদিকদের সাথে কথা হলে তারা জানান, বিষয়টির সত্যতা যাচাই করার জন্য ঘটনাস্থলে গেলে অভিযুক্ত আহম্মেদ আলী ও তার তিন পুত্র আমাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে এক পর্যায়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বাশের লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করে আমাদের হাতে থাকা ক্যামেরা, স্বর্নের চেইন ও আংটি কেড়ে নেয় নেয়। সরেজমিনে গিয়ে দেখি সরকারি সেই ভবনটি এখন নতুন রুপে দোকান নির্মান করে সেখানে মা, জান ট্রেডিং এজেন্সি নামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর নতুন রুপে নির্মানকৃত প্রতিষ্ঠানের দোকানের সামনে দেওয়ালে টাইলস দিয়ে লেখা রয়েছে এই সম্পত্তির মালিক রেহেনা আহম্মেদ।
এবিষয়ে কুষ্টিয়া সদর ভূমি কর্মকর্তা এসিল্যান্ড দবির উদ্দিনের সাথে মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা লিখিতভাবে জেলা প্রশাসক স্যারকে ছবি সহ অভিযোগ পাঠানো হয়েছে। আহম্মেদ আলী ভুয়া জাল দলিল করে হাই কোর্টকে ভুলভাল বুঝিয়ে একতরফা রায় নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তদন্ত করে দেখা যায় দলিলটি জাল। হাইকোর্ট থেকে তার রায় স্থগিত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মহোদয় আহম্মেদ আলীকে নির্দেশনা দিয়েছে। বর্তমানে সেটি এখনো সরকারি সম্পত্তি। সরকারি সম্পত্তির ভবন ভেঙ্গে মূল্যবান লোহার বিম চুরি করে বিক্রয়ের অভিযোগে আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহনের জন্য জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করা হয়েছে।
মামলা গ্রহন না করার বিষয়ে অদ্য ১২ তারিখ দুপুরে কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার খাইরুল আলমের মুঠোফোনে কথা হলে, তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি তেমনটি অবগত নই। তবে প্রকৃতপক্ষে সরকারী সম্পত্তি দখল করে নেওয়া ব্যক্তিরা যদি সাংবাদিকদেরকে লাঞ্চিত ও ছিনতাই করে থাকে তাহলে আমি তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এখনই জানিয়ে দিচ্ছি। অন্যদিকে মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আমি একটু বাইরে আছি, তবে উক্ত মামলার বিষয়টি এস আই দিপঙ্করকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তিনি তদন্ত করবেন।