গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের তিনটি পাম্প অচল দিশাহারা কৃষক

প্রকাশিত: ১১:৫৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ১০, ২০২৪
কে এম শাহীন রেজা কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি।।
দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষের (জিকে) কার্যক্রম বন্ধ থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কুষ্টিয়াসহ পার্শ্ববর্তী ৪ জেলার কয়েক লাখ চাষী। সেচ প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পদ্মায় পানির স্তর স্বাভাবিক থাকলে প্রকল্পের একেকটি পাম্প প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ২৮ হাজার ৩১৬ দশমিক ৮৫ লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে। মোট তিনটি পাম্পের মধ্যে ৩ ও ২ নম্বর পাম্প দুটি ২০১৭ ও ২০২১ সালে থেকে বিকল।
১৯৬২ সালে এই প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে চ্যানেলের মাধ্যমে পানি এনে পাম্প করে সরবরাহ খালের মাধ্যমে ৪ জেলার ১৩টি উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় সেচযোগ্য এলাকা রয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ১০৭ হেক্টর। শুরুতে বছরের ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর) দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ৩টি পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হতো। বাকি দুই মাস চলত রক্ষণাবেক্ষণ। ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের পানি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার কৃষকদের সেচ দেওয়ার এ কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরা জেলার ১ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের লক্ষ্য ছিল। প্রকল্পের স্বর্ণযুগে নব্বইয়ের দশকে ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়। জি-কে সেচ প্রকল্পের আওতায় তিনটি পাম্পের সাহায্যে পানি দেওয়া হতো। এ বছর ১ ফেব্রুয়ারিতে ১ নম্বর পাম্প চালু করে পানি ছাড়া হয়।  কিন্তু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বশেষ সচল পাম্পটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কুষ্টিয়া সদর ও মিরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গাসহ  এই চার উপজেলার কৃষকেরা চরম  দুর্ভোগে পড়েছেন। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান লাগাতে পারছেন না, কারও ধানের জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। আরার কেউ কেউ শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করেছেন। বর্তমানে প্রকল্পের আওতায় ৯৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব ছিল। দুটি মেশিন আগে থেকে নষ্ট থাকায় চলতি বোরো মৌসুমে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার সক্ষমতা ছিল প্রকল্পের। শেষ পাম্পটি নষ্ট হওয়ায় এবার সেই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হলো না।
কুষ্টিয়ার কৃষকরা জানান, বিঘা প্রতি কৃষকেরা মাত্র ২০০ টাকার বিনিময়ে সেচ প্রকল্পের (জিকে) মাধ্যমে পানি পেতেন। সেচ প্রকল্পের (জিকে) মাধ্যমে পানি না পাওয়ায় বর্তমানে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে সেচ বাবদ প্রতি বিঘায় খরচ বেড়েছে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার। স্বল্প খরচের সেচব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ৩০ থেকে ৩৫  গুণ বেশি খরচ করে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে ধানের জমিতে সেচ দিচ্ছেন কৃষকরা। কতদিন পর থেকে আবার ধানের জমিতে সেচ প্রকল্পের পানি পাবেন তার কোনো সঠিক তথ্য  দিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
তারা আরো জানান, সেচ প্রকল্পের প্রধান এবং শাখা খালে পানি থাকলে সেচের পাশাপাশি আশপাশের নলকূপ ও পুকুরে পানি স্বাভাবিক থাকে। তবে এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো নলকূপে পানি পাওয়া নাও যেতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করেন। কৃষকেরা বলছেন, বোরো ধানে সবচেয়ে বেশি সেচ দিতে হয়। খেত প্রস্তুত থেকে শুরু করে দানা আসা পর্যন্ত সেচ লাগে। কখনো দিনে দুইবারও সেচ দিতে হয়। জানুয়ারি থেকেই ধান আবাদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু পানি সরবরাহ শুরুর ১৯ দিনের মাথায় হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিশাহারা অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। অনেকেই আবার শ্যালো মেশিনের সাহায্যে সেচ টাকা জোগাড় না করতে পারায় ধান লাগানো বন্ধ রেখেছন।
জি-কে কৃষক সমিতির সভাপতি আলাউদ্দিন বলেন,বিশ্বাস বলেন, এ বছর আমরা এখনো পানি পাইনি। এই মৌসুমে পানি পাওয়া যাবে না এমন তথ্য পাওয়া গেছে । আমরা এখন স্যালো মেশিনের পানি দিয়ে ধান রোপণ করছি। এভাবে এক বিঘা জমি চাষ করতে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ লিটার তেল (ডিজেল) লাগছে। এ ছাড়া  ভাড়াসহ বিঘাতে কমপক্ষে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা বেশি ব্যয় হচ্ছে। এতে চলতি বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন ব্যয় অনেক বাড়বে। বাড়তি খরচের আশঙ্কায় অনেক কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবিলম্বে পানি সরবরাহ চালু করে হাজারো কৃষককে বাঁচাতে হবে। না হলে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুষ্টিয়া কার্যালয়ের উপপরিচালক হায়াত মাহমুদ বলেন, পাম্প বন্ধ হওয়ার কারণে বোরো চাষে কৃষকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হবে। বিয়ষটি আমি কৃষি সম্প্রসারণের ঢাকা অফিসকে অবহিত করেছি। সম্প্রসারণ কর্মীদের মাধ্যমে কৃষকদেরও খবর দেওয়া হয়েছে। হয়তো ফলন কম হবে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে ধান রোপণে কৃষকদের অনেক ব্যয় বাড়বে। বোরো ধান রোপণের অনুরোধ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যেভাবে জি-কে সেচ প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের কৃষি কাজে পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা খুবই দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পটি সচল এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলকে খাদ্যে স্বনির্ভর করতে সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে অ্যান্টি ফারাক্কা তথা গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ করা ।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্পের পাম্প ইনচার্জ মিজানুর রহমান বলেন, দুটি পাম্প আগে থেকেই নষ্ট। তৃতীয় পাম্প দিয়ে ৩১ জানুয়ারি ক্যানেলে পানি সরবরাহ শুরু হয়। কারিগরি ত্রুটির মুখে ১৯ ফেব্রুয়ারি ওই পাম্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কবে নাগাদ সেচ কার্যক্রম চালু করা যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। মিজানুর রহমান আরও বলেন, মেনটেনেন্স বাবদ প্রতিবছর ৫০ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ হয়। গত বছর প্রায় ৫৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
সেচ প্রকল্পের উপপ্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, এই সময়ে পদ্মায় পানি কম থাকায় দুটি জেলার মাত্র ৪টি উপজেলায় পানি সরবরাহ হয়ে থাকে। বর্তমানে পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ পাম্প চালু হবে, সেটাও কর্তৃপক্ষ বলতে পারছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুষ্টিয়ার পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান জানান, বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। চার জেলার সর্বমোট ১৩টি উপজেলায় জিকের সেচ কার্যক্রম বিস্তৃত। প্রকল্পের প্রধান তিনটি খাল, ৪৯টি শাখা খাল ও ৪৪৪টি উপশাখা খাল রয়েছে।



error: Content is protected !!