ঢালিউডের নায়করাজ রাজ্জাক। তিনি কিংবদন্তি। সাড়ে তিন বছর হলো তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শক এবং তার সহকর্মীদের হৃদয়ে তিনি সব সময় উজ্জ্বল। আজ এই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতার জন্মদিন। তাকে ছাড়াই পালিত হবে তৃতীয় জন্মদিন। বিশেষ দিনটিতে প্রিয় মানুষকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তার কয়েকজন তারকা সহকর্মী
জীবনের সুন্দর দিনগুলো আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি
সুচন্দা, চিত্রনায়িকা
পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে প্রায় ৩০টি সিনেমায় আমরা জুটি বেঁধে কাজ করেছি। জীবনের সুন্দর দিনগুলো আমরা একসঙ্গে এফডিসিতে শ্যুটিং করে কাটিয়েছি, গল্প করেছি, আড্ডা দিয়েছি, ঝগড়া করেছি, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করেছি। চলচ্চিত্রের জন্য এক হয়ে কাজ করেছি। শ্যুটিং না থাকলেও আমরা শুধু আড্ডা দেওয়ার জন্য এফডিসিতে ছুটে এসেছি। এই এফডিসিতেই তাকে শেষ বিদায় জানিয়েছিলাম। তিনি আমার খুব ভালো বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। সেখানে আমিও বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছি। অনেক কাছ থেকে দেখেছি চলচ্চিত্র নিয়ে কীভাবে কাজ করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি দিন তৈরি করতে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। আজ তার জন্মদিনে এই স্মৃতিগুলো মনে করতে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে।
তিনি আমাদের আগলে রাখতেন
ফারুক, চিত্রনায়ক
ইতিহাসের এই মহানায়ককে নিয়ে আমি কী বলব। আমি ওনাকে নিয়ে বলার মতো ভাষা আর খুঁজে পাচ্ছি না। বাংলা চলচ্চিত্রে রাজ একজনই, তাকে আর ফিরে পাব না। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক চলচ্চিত্রের একজন মানুষ। আমার বড় ভাইয়ের মতো। এখন সিনেমার নায়কদের মধ্যে যে রেষারেষির সম্পর্ক, তা দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। রাজ্জাক ভাই, আলগমীর, সোহেল রানা, ওয়াসিম, জসিম, জাফর ইকবাল, উজ্জ্বল, আমিÑ সবাই একই সঙ্গে সমান চাহিদা নিয়ে কাজ করেছি। ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছি। আমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল না। বিশেষ করে রাজ্জাক ভাই আমাদের আগলে রাখতেন অভিভাবকের মতো। তাকে হারিয়ে আমি মাথার ওপর থেকে সেই বটগাছের ছায়া হারিয়ে ফেলেছি। আমি ভাই হারিয়েছে। অন্য সময় তার কথা মনে পড়লেও তার জন্মদিন ও মৃত্যুদিনে নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আমার খুব কান্না পায়। আল্লাহ তাকে ভালো রাখুন।
৩৫টির মতো সিনেমায় আমরা
জুটি হয়েছি
অঞ্জনা, চিত্রনায়িকা
সোহেল রানা ভাই আমাকে চলচ্চিত্র জগতে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আমি বেশি কাজ করেছি। ৩৫টির মতো সিনেমায় আমরা জুটি হয়েছি। এর মধ্যে আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম দুটি সিনেমা রয়েছে। ‘অশিক্ষিত’ সিনেমাটি দিয়ে আমাদের জুটির পথচলা শুরু। সেই সিনেমার ‘আমি যেমন আছি তেমন রবো’ এবং ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে’ গান আজও মানুষের মুখে মুখে। ‘অভিমান’ সিনেমার ‘বাবা রে বাবা, ক্যান দিলা বিয়া’ গানটিও খুব জনপ্রিয়। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনি অভিনয়ের ব্যাপারে অনেক সহযোগিতা করতেন। তবে গানের শ্যুটিংয়ে তিনি বলতেন, ‘অঞ্জনা, এবার তোমার পালা। আমার নাচ শিখিয়ে দাও।’ কি যে ভালো মানুষ ছিলেন তা বলে বোঝানো যাবে না। আমার সৌভাগ্য যে তার মতো কিংবদন্তির সঙ্গে এত কাজ করেছি। তিনি চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু কোটি দর্শকের হৃদয়ে বেঁচে আছেন। মাঝে মাঝে অনুভব করি, চলচ্চিত্র জগৎ কি হারিয়েছে। রাজ্জাক ভাই, এক অদ্বিতীয়। তার কোনো তুলনা হয় না। আল্লাহ তার আত্মাকে শান্তিতে রাখুন।
তিনি আমাকে তুই করে ডাকতেন
শাবনূর, চিত্রনায়িকা
রাজ্জাক আংকেল ছিলেন আমার শিক্ষক, আমার বাবার মতো। শুধু আমার নয়, চলচ্চিত্রের প্রতিটি মানুষ তাকে বাবার মতো শ্রদ্ধা করতেন। তার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শিখেছি। আমাকে দেখেই হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আয় মা, কাছে এসে বোস। কত দিন পর তোকে দেখলাম।’ তিনি আমাকে প্রচণ্ড আদর করতেন। ‘তুই’ করে বলতেন। তার যেকোনো আয়োজনে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। চলচ্চিত্রে আমি অনিয়মিত হওয়ায় অনেকেই মন খারাপ করতেন। তাদের মধ্যে রাজ্জাক আংকেল ছিলেন অন্যতম। আমি এখনো মেনে নিতে পারি না যে তিনি আর নেই। তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন এখনো।
এ ক্ষতি কখনো পূরণ হবে না
মিশা সওদাগর, অভিনেতা
রাজ্জাক সাহেব ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। সব সময় তিনি চলচ্চিত্রের পাশে ছিলেন। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের জন্য তিনি যে কত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তা বলে বা লিখে ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব না। তার নামের মধ্যে যে ভার, সেটা বহন করা কঠিন একটা কাজ। তাকে নিয়ে মন্তব্য করার সাহস আমার কখনো হয়নি। তিনি নিজেই একজন ইনস্টিটিউট। একজন অভিভাবককে হারিয়েছি। এ ক্ষতি কখনো পূরণ হবে কি না জানি না। এই ইন্ডাস্ট্রি তার অবদান কোনো দিন ভুলবে না।