এখন লটকনের মৌসুম। গাছে-গাছে ঝুলছে সুস্বাদু টকমিষ্টি ফল লটকন। শুনেছি লটকনের জন্য বিখ্যাত নরসিংদীর গিলাবে। তাই লটকনের স্বাদ আর সৌন্দর্য দেখতে বন্ধু হুমায়ুন কবিরের আমন্ত্রণে বন্ধুদের নিয়ে গিয়েছিলাম নরসিংদীতে। আমরা যাব এবং কোথায় কোথায় ঘুরব এটা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন মাসুদ রানা। কারণ, সব বাগানের ফলন এক রকম না। সকালবেলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম নরসিংদীর গিলাবের উদ্দেশে।
ঢাকা থেকে শিবপুর উপজেলার গিলাবে গ্রামে পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় তিন ঘণ্টা। ততক্ষণ আমাদের আরেক বন্ধু মনির অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। আমরা পৌঁছামাত্র তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলাম। কারণ আমরা তো ঘুরতে এসেছি। কারও বাসায় বেড়াতে আসিনি। তবুও অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হলো। বাড়িতে ঢুকতেই অবাক হলাম। বসতবাড়ি নয় যেন বাগানবাড়ি। বাড়ির আঙিনায় নানা ধরনের ফল ও ফুলগাছ। কাঁচা-পাকা লটকন আর বিশাল বিশাল আকারের কাঁঠাল ঝুলছে গাছে গাছে। আমার অন্য বন্ধুরা লটকন-কাঁঠালে হাত বুলিয়ে ফটোসেশনে ব্যস্ত।
দুপুরের খাবার শেষ করে বাড়ি থেকে বের হতে প্রায় ৩টা। আর দেরি নয়, বের হয়ে গেলাম বাগান দেখতে। এখান থেকে বাগান প্রায় দুই কিলোমিটার। গাড়ি চলছে দুপাশের সবজিক্ষেতের মাঝদিয়ে পিচ করা সরুপথে। চারপাশ সবুজ আর সবুজ।
প্রকৃতি যেন সব উজাড় করে দিয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাগানে। সেখানেও অপেক্ষায় ছিল লটকন বাগানের মালিক সালাম ভাই। তার সঙ্গে গল্প করে করে বাগানের মধ্য দিয়ে যতই এগিয়ে যাই, ততই যেন মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি।
গাছে গাছে ঝুলছে লটকনের স্তূপ। যত দূর চোখ যায়, শুধু লটকন আর লটকন। অনুমতি থাকায় আমরা যে যার ইচ্ছামতো গাছ থেকে লটকন নিয়ে খাচ্ছিলাম। সে এক অন্যরকম অনুভূতি।
নরসিংদীর পুরো জেলাটাই নানা ফল আর সবজির জন্য বেশ বিখ্যাত। তবে লটকন ফল নরসিংদীর দুটো উপজেলা বেলাব ও শিবপুরে মূলত বেশি হয়। তার মধ্যে গিলাবের, বটেশ্বর, লাখপুর, আজলিতলা, ওয়ারী ও মরজাল গ্রামগুলো বেশ প্রসিদ্ধ। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় রয়েছে লটকনগাছ। সেই সঙ্গে পরিকল্পিত বাগান। কোনো কোনো গাছে ৩১৫ কেজি পর্যন্তও লটকন ধরে।
এসব গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই লটকন ফল বিক্রির ওপর নির্ভরশীল। চারা রোপণের তিন বছরের মাথায় ফলন আসতে শুরু করে, যা প্রায় ষাট বছর বয়স পর্যন্ত গাছটিতে ফল ধরে থাকে। পরিচিত সালাম ও সজীব ভাইয়ের বাগানসহ নানাজনের বাগান ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
এর মধ্যে একটি লেবু বাগানেও গিয়েছিলাম। লেবু বাগানে ছোট ছোট গাছে বড় বড় লেবু ঝুলতে দেখলাম। ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও নরসিংদী- তিন জেলাতেই লটকন পাওয়া যায়। তবে নরসিংদীর লটকন আকার ও স্বাদে সুস্বাদু। নরসিংদীর মরজাল হলো লটকনের বৃহৎ পাইকারি বাজার। লটকন কেনার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে পাইকাররা আসেন।
লটকন জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস গাছে ধরে। লটকনগাছ খুব একটা পরিচর্যা করারও প্রয়োজন পড়ে না। তাই স্থানীয়রা লটকন বাগানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
লটকন ফল নানা জেলায় ভিন্ন ভিন্ন নামে ডেকে থাকে। যেমন লটকা, ডুবি, বুবিসহ হরেক নামে। দিন শেষে আমরাও নানা গাছের লটকন চেখে, পছন্দমতো গাছের উৎকৃষ্ট মানের সু-স্বাদু লটকন নিয়ে হুমায়ুন ভাইয়ের বাড়ি পথ ধরলাম।
তার বাড়িতে এসে সিংদীর প্রসিদ্ধ পিঠা ঝিনুক, ফুলপাতা, কাঁঠালিসহ নানা পিঠা খেলাম। বাড়ির ছাদে উঠে দেখি চারপাশে শুধু গাছগাছালি আর সবজিক্ষেত। পুরো গ্রামটিই যেন নানা শস্যের ভা-ার। ফেরার সময় অনেক ধরনের সবজি, কাঁচা-পাকা কাঁঠাল, ডেউয়া ফল নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে গাড়িতে উঠে বসলাম।