পাটিগণিতের ভাষায় ধরা যাক, আওয়ামী লীগ সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সত্য বলছে। আমরা তো অঙ্ক শেখার প্রয়োজনে এমন কত হিসাব ধরে নিয়ে ফল মিলিয়েছি ছোটবেলায়। সে রকমই না হয় ধরা গেল, তারা সত্য বলছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের কথামতো কোনো ভোট জালিয়াতি হয়নি। দিনের ভোট রাতে নেওয়া হয়নি, সেটাও ধরে নিলাম। আরও ধরে নিলাম, যে ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে তা ঠিকই আছে। মৃত মানুষের ভোট দেওয়াও কোনো দোষের ব্যাপার না। যে ৫৮৬ কেন্দ্রে প্রদত্ত ভোটের শত ভাগই আওয়ামী লীগ পেয়েছে আর ধানের শীষ শূন্য ভোট পেয়েছে, সেটাও ঠিকই আছে। সেখানকার বিএনপি নেতারাও দলেবলে নেচে গেয়ে নৌকায় ভোট দিয়ে এসেছেন। ধরে নিলাম, রাশেদ খান মেনন যে বলেছেন, ‘বিগত নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত (এমপি) হয়েছি। তারপরও আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি, গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জাতীয়, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ’; সেটা তার অসংলগ্ন কথা। সরকারের শরিক দল জাসদ যে বলেছে, রাতে ভুয়া ভোট হওয়াতে নির্বাচনের পর বিষণœতায় আক্রান্ত হয়েছে পুরো জাতি, সে বক্তব্যও অসাড়। টিআইবি যে বলল, ৩০০ আসনের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া ৫০টি আসনের ৪৭টিতে নির্বাচনের দিন কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে এবং এর ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে, তাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা প্রচারণা বলেই না হয় ধরে নিলাম। আর বিদেশি সংবাদমাধ্যম যে বাংলাদেশের নির্বাচনকে একটি ‘ফ্রডুলেন্টলি ট্রান্সপারেন্ট ইলেকশন’ (‘অবিচুয়ারি অব এ ডেমোক্রেসি : বাংলাদেশ’, দ্য ইকোনমিস্ট) বলেছে, সেটাও বাড়াবাড়ি রকমের মিথ্যা বয়ান বলেই মেনে নিলাম। সব মিথ্যা। শুধু সত্য কথা বলছে সরকার ও ইসি।
ইসির সত্য বয়ানে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে যে তথ্যটি আমরা পাই তা হলো, সাধারণ ব্যালটে নির্বাচন হওয়া ২৯৪টি কেন্দ্রে ভোট পড়ার হার ৮০ দশমিক ৮০। আর ইভিএমে নির্বাচন হওয়া ছয় কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ। ইসির মতে ৮১ শতাংশ সহি। ৫১ শতাংশও সহি। কিন্তু এই দুই সহি হিসাবের মধ্যে ৩০ শতাংশের ফারাক কেন? পার্র্থক্য তো শুধু পদ্ধতির। একটাতে কাগজ, আরেকটাতে মেশিন। নির্বাচন যদি সঠিক ধরে নেওয়া হয়, তাহলে শুধু কাগজ থেকে মেশিনে যাওয়ার জন্য যে ৩০ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তার দায় কার? নির্বাচন কমিশনের কাজ তো ভোটারকে ভোটমুখী করা, ভোটবিমুখ করা নয়। তাহলে ইসি জেনে বুঝে ভোটারকে ভোটবিমুখ করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে কেন? সম্প্রতি চট্টগ্রাম ৮ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে ভোট হয়েছে। তাতে ভোট পড়েছে মাত্র ২২ শতাংশ! তারপরও ইসি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম দিতে মরিয়া কেন?
নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী লীগকে তো একটা মেনে নিতে হবে। হয় স্বীকার করে নিতে হবে যে দিনে-রাতে ভোট করে ব্যাপক জালিয়াতির ফল ৮১ শতাংশ ভোট পড়া। অথবা মেনে নিতে হবে ইভিএম ভোটারকে ভোটবিমুখ করে।
আসলে ওই ৮১ এবং ৫১ শতাংশ দুটোই যে জালিয়াতির ফলাফল, সেটা প্রধান নির্বাচন কমিশনসহ সব কর্তারাই জানেন। জানেন বলেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। কিন্তু তিনি কি রাতের ভোট বা ভোট জালিয়াতি বন্ধ করতে ইভিএমপ্রীতি দেখাচ্ছেন? মোটেই না।
আওয়ামী লীগ সরকার এগারো বছর ধরে প্রতিটি নির্বাচনে খুব স্মার্টলি জালিয়াতি করেছে। পাঁচ ধাপের পৌর নির্বাচনের শুরুর ধাপ মোটামুটি সুষ্ঠু করে দেখিয়ে বিএনপির লোভ জাগিয়ে পরের ধাপগুলো সব কেড়ে নিল। আবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বিএনপিকে চাপে ফেলে এমন অবস্থা করল যে, তারা সব জায়গায় প্রার্থী পর্যন্ত দিতে পারল না। পরে নিজেদের বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বিপাকে পড়ে সে নির্বাচনে নিজেরা খুনোখুনি করে ১১৬ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। সে নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংসতাপূর্ণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন হিসেবে কলঙ্কিত হয়ে আছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে প্রশাসনিক চাপ ও দলীয় সন্ত্রাসী ব্যবহার করে এমন অবস্থা করেছিল যে, বিএনপি বেশির ভাগ কেন্দ্রে তাদের দলীয় এজেন্ট পর্যন্ত দিতে পারল না। একাদশ জাতীয় নির্বাচন আবার করল পুরোপুরি প্রশাসনকে ব্যবহার করে। দিনের ভোট জালিয়াতি রেখে দেশে শুরু হলো এক নতুন ভোট কালচার-রাতের ভোট! এভাবে একেকবার একেক কৌশল নিয়ে ভোট জালিয়াতিতে ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এতে নির্বাচন কমিশন হুকুম তামিল কমিশন মাত্র।
এই যে হরেক রকম কৌশলের ভোট জালিয়াতি, তার সবগুলোই তো হজম করে ফেলল আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপিসহ সরকারের বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলগুলো তো কিছুই করতে পারল না। কাগজেও জালিয়াতি করবে, ইভিএমেও জালিয়াতি করবে। ফলাফল তো অভিন্ন। তাহলে ইভিএম নিয়ে বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দলের আপত্তির কারণ কী? এ প্রশ্নটিও কেউ কেউ তুলছেন। আর কাগজে জালিয়াতি করেও তো সরকারের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তারা জোরালো কোনো বাধার মুখে পড়েনি এখনো। তাহলে সরকারইবা ইভিএম এনে কেন নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে? এ প্রশ্নও করতে পারেন কেউ। এর উত্তর আগেও দিয়েছি। সরকার প্রতিটি নির্বাচনেই জালিয়াতির ধরন কিছুটা পাল্টে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাদের নতুন মনোযোগের জায়গা ইভিএম। এটি হতে পারে তাদের ভবিষ্যৎ বড় জালিয়াতির পরিকল্পনার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ। যত স্মার্টলি যত পদ্ধতিই প্রয়োগ করুক না কেন, প্রতিটি নির্বাচনেই ভোট জালিয়াতির কিছু না কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে। কাগজের ভোটে জালিয়াতির ধরা পড়ে যায় সহজেই। সে ক্ষেত্রে সরকার হয়তো মনে করছে ইভিএমে ভোট জালিয়াতি করলে তার কোনো প্রমাণ থাকবে না। এটা করা সহজ। মারামারি কাটাকাটি ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছামতো রেজাল্ট বানালেও কারও ধরার উপায় থাকবে না। আর ব্যালটের ভোটে কাটাকাটি করে সিল মেরে ভোট নিলে শতভাগ ও শূন্য ভোটের যে বিড়ম্বনা তৈরি হয়, ইভিএমে হয়তো সেটা হবে না।
এ সরকার প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে ইভিএমের সাফাই গাইছে। ব্রিটেন, গ্রিস, অস্ট্রেলিয়াসহ বহু উন্নত দেশ কি প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে? তারা কেন ইভিএম ব্যবহার করছে না? কিছু দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সীমিত আকারে চালু থাকলেও জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম এখনো শত হাত দূরে।
মেশিন কি নিজে কখনো সৎ, অসৎ হয়? মেশিনের সততা নির্ভর করে তার পেছনের মানুষের ওপর। ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। মেশিনের পেছনের পরিচালক কেমন, তার ওপর নির্ভর করে মেশিন কী আচরণ করবে। যেসব দেশে এই মেশিনের পেছনের লোকগুলোর সততা নিয়ে এত প্রশ্ন নেই, সেখানে পর্যন্ত ইভিএম সন্দেহমুক্ত হতে পারছে না। আর বাংলাদেশে যেখানে মেশিনের পেছনের মানুষগুলো বারবার প্রমাণিত জালিয়াত বা জালিয়াতের সহযোগী, সেখানে ইভিএমে আস্থা থাকে কী করে!
ইভিএমে যে কত ধরনের জালিয়াতি করা যায়, তা অনেকের চিন্তারও বাইরে। রাতের ভোট বন্ধ করার জন্য ব্যালটের পরিবর্তে ইভিএমে সিইসি জোর দিলেও এই মেশিন কোনোভাবেই রাতের ভোট বন্ধ করতে পারবে না। সকাল ৮টায় যে মেশিনটি ওপেন হবে, সে জিনিসটা তো একজন মানুষই সেট করবে। সুতরাং সে যদি আগের রাত ১১টায় ওপেন হওয়ার সেটিং দেয়, তবে আগের রাতেই ওপেন হবে। প্রিসাইডিং অফিসার ভোটারদের ডিটেইল বের করতে পারবেন। একজন ভোটারের আঙুলের ছাপে যদি তার প্রোফাইল ওপেন না হয়, তবে তা ওই প্রিসাইডিং অফিসার ওপেন করে দিতে পারেন বলে একাধিক ভোটার জানিয়েছেন। অনেক সময় আঙুলে তেল থাকলে, কোনো কারণে আঙুলের স্কিন মরফোলোজি পরিবর্তিত হয়ে গেলে আঙুলের ছাপে ভোটারের প্রোফাইল ওপেন নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং অফিসার ভোটার আইডি নাম্বার জেনে তা ওপেন করে দিতে পারেন। যেহেতু প্রিসাইডিং অফিসার ওপেন করতে সক্ষম, তাই তার সততার ওপর নির্ভর করবে ইভিএমে ভোট জালিয়াতি হবে কি না। অনেক ভোটার ভোট দিতে গেছেন। তাদের আঙুলের ছাপ দিয়ে ওপেন করার পর কেন্দ্রে থাকা কোনো প্রার্থীর লোকজন বাটন টিপে ভোটটি দিয়ে দিল। এমন ঘটনাও ঘটেছে। একজন নির্বাচন কমিশনার সম্প্রতি এই কথা স্বীকারও করেছেন।
ইভিএম মেশিনে যে কতভাবে জালিয়াতি হতে পারে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন আমেরিকান নামকরা কম্পিউটার বিজ্ঞানী বারবারা সায়মনস। ‘দ্য কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট হু প্রেফারস পেপার’ শিরোনামে ৭৬ বছর বয়সী এই কম্পিউটার বিজ্ঞানীর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপে দি আটলান্টিকের ডিসেম্বর ২০১৭ সংখ্যায়। এতে তিনি তুলে ধরেছেন ইভিএমে জালিয়াতির যত উপায়। এমনকি এটাকে কীভাবে হ্যাক করা যায়, তাও দেখিয়েছেন এই বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে ইভিএমের পক্ষে ওকালতি করা বিজ্ঞজনরা বারবারা সায়মনসের চেয়েও বড় প্রযুক্তিবিদ কি নাÑ সে প্রশ্ন তোলা বোধ করি অন্যায় হবে না।
কোনো কোনো দেশে ইভিএম ব্যবহার সে দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না সে প্রশ্নও উঠেছে। বাংলাদেশে সংবিধানের সঙ্গে কোনোভাবে এ পদ্ধতি অসংগতিপূর্ণ কি নাÑ সে প্রশ্ন খতিয়ে দেখতে পারেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
সরকার যত কৌশলই বের করুক না কেন, তা মানুষের বোধের বাইরে না। কোনটি যে প্রকৃত নির্বাচন আর কোনটি জালিয়াতির নির্বাচন, সে বিবেচনা এ দেশের মানুষের আছে। ফলে ভোট জালিয়াতির বহুবিদ কৌশল প্রয়োগ করে জিততে পারলেও জালিয়াতির দায় থেকে যে মুক্তি মিলবে না, এটা নিশ্চিত। তাই দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, মানুষের ভোটের অধিকার রক্ষার স্বার্থে কৌশল অপকৌশল বাদ দিয়ে একটি সত্যিকারের সিটি নির্বাচন দিলে তাতে আওয়ামী লীগেরও উপকারই হবে।