ওয়াজের নামে হচ্ছেটা কী?

প্রকাশিত: ১২:২৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২২, ২০২০

সাধারণত ওয়াজ-নসিহত নিয়ে আমি কিছু লিখি না। সব সময় ভেবে এসেছি ওটা আলেম-ওলামাদের ব্যাপার। এখনও যে খুব বেশি ব্যতিক্রম কিছু ভাবছি তা নয়, তবু কিছু কথা লিখতে হচ্ছে।

একজন শ্রোতা হিসেবেই বলছি, হালজামানার ওয়াজ-নসিহত আমাকে দারুণভাবে আহত করে। অধিকাংশ তরুণ-যুবক বক্তার ওয়াজ-নসিহতকে এখন আর ওয়াজ বলে মনে হয় না। ওগুলোকে ওয়াজের নামে অন্যকিছু মনে হয়। মনে হয় ওয়াজ না, ওয়াজের কুস্তি।

ছোটবেলায় আমরা অনেক দূরে দূরে ওয়াজ শুনতে যেতাম। নাম করা আলেম-ওলামাদের ওয়াজ-নসিহত শুনতাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তাদের ওয়াজে দরদ ছিল। মোলায়েম সুর ছিল। তাদের ওয়াজ শুনলে মন নরম হয়ে যেত।

মনে হতো তারা মুখ দিয়ে কথা বলতেন না, কথা বলতেন হৃদয় দিয়ে। দরদ ভরা সুরের ওয়াজগুলো শ্রোতাদের কানে নয়, হৃদয় গিয়ে আঘাত করত। বহু মানুষ বদলে যেত। আমল আখলাখে শুদ্ধ হতো। তখন ওয়াজ-নসিহতকে সমাজ সংস্কারের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করা হতো।

কিন্তু এখন আর তেমনটা হয় না। এখনের ওয়াজগুলো বদলে গেছে। বক্তারা হৃদয় দিয়ে কথা বলেন না। শ্রোতাদেরও হৃদয় স্পর্শ করে না। বরং এ সময়ের তথাকথিত ওয়াজ সমাজে বিশৃংক্ষলা সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গেছে, বদলে যায়, আপগ্রেড হয়। এখন কোরআন হাদিস নিয়ে অনেক বেশি গবেষণা হয়। এখনের তরুণ-যুবক আলেমদের বিদ্যা-বুদ্ধি সে সময়ের আলেমদের থেকে অনেক বেশি অগ্রসর।

কিন্তু ওয়াজ-নসিহতে এর বাস্তব প্রতিফলন হচ্ছে না। আমাদের ওয়াজ সংস্কৃতি হাইজ্যাক হয়ে গেছে। আমলদার আলেম, পীর মাশায়েখদের পরিবর্তে চলে গেছে ওয়াজ ব্যবসায়ীদের দখলে।

এখনের ওয়াজ মানেই চিল্লাপাল্লা, হাসাহাসি, ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ আর পরচর্চা। কোনো কোনো বক্তার ওয়াজ শুনে বুঝতে পারি না ওগুলো ওয়াজ নাকি ভানু মতির কৌতুক। বক্তা গলার রগ ফুলিয়ে, শরীরের সর্বশক্তি এক জায়গায় করে চিৎকার করেন। হুমকি-ধামকি দেন। চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলেন। গিবত শেখায়েত করেন।

সিনেমা বায়োসকোপের গান করেন। তিরস্কার করেন। ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ করেন। আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি করেন। যা কোনোভাবেই আমাদের ঐতিহ্যবাহী ওয়াজ সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ওগুলো পরিষ্কার অশ্লীলতা। সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাগত অবক্ষয়।

অধিকাংশ ওয়ায়েজের কথা শুনে সহজেই বোঝা যায় কোরআন-হাদিসের আলো তাদের মধ্যে নেই। গলার সুর বা গলার শক্তির উপর নির্ভর করে তারা ওয়াজব্যবসা করেন।

ঘুরেফিরে একই কথা বারবার বলেন। ভুল-বানোয়াট তথ্য দেন। অশুদ্ধ, অশালীন ভাষায় কথা বলেন। ব্যক্তিগত গল্প, পারিবারিক কেচ্ছা আর অন্যের দোষ ধরা, গিবত করা ছাড়া বিশেষ কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের ওয়াজে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ওয়াজ করেন নাকি মাস্তানি করেন তাও বুঝতে পারি না।

এখানে প্রাসঙ্গিক না হলেও উদাহরণ হিসেবে বলছি, ৯০-এর দশকে বাংলা চলচিত্রের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কোনো মেধাবী পরিচালক সিনেমা বানাতেন না। সে সময়ের চলচ্চিত্র পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে দেখতে পারতেন না। গল্প এবং অভিনয়ের পরিবর্তে শরীরনির্ভর অশ্লীল খিস্তি-খেউড়ে ঠাসা থাকত চলচ্চিত্র নামের ওই বন্তুগুলো।

মাস্তানি, গুণ্ডামি, হুমকি-ধামকি আর ধর্ষণ চিত্র ছিল ওই সব সিনেমার প্রধান খোরাক। যার কুপ্রভাব এখন সমাজের পরতে পরতে আমরা দেখতে পাচ্ছি। ধর্ষণ, অশ্লীলতা, গালাগাল এখন সামাজিক বিভীষিকায় পরিণত হয়েছে। দেশি চলচ্চিত্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। দেশ ছেয়ে গেছে বিদেশি অশ্লীল সংস্কৃতিতে।

আমি মনে করি ওয়াজ-নসিহতের ক্ষেত্রেও এখন সব থেকে বেশি খারাপ সময় যাচ্ছে। ওয়াজের নামে যার যা ইচ্ছা তাই বলছে, করছে। কোরআন-হাদিসের বয়ান নেই, রাসূলের (স.) সিরাত নেই, শুধু চিৎকার-চেঁচামেচি আর পরনিন্দা, পরচর্চা করা হচ্ছে।

ইসলামে নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, সন্তানের অধিকার, মা-বাবার অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, শিক্ষার গুরুত্ব, খুন, ধর্ষণ, মাদক নিয়ে কেউ মৌলিক আলোচনা করে না, করতে পারে না। পরস্পরকে আক্রমণ করে, পরস্পর বিরোধী মনগড়া ফতোয়া দিয়ে সময় পার করে আর ধর্মপ্রাণ মানুষের পকেট লুট করে।

আমাদের দেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে সুফিবাদের একটা বড় ভূমিকা আছে। যারা পীর মুরিদি ধারায় ইসলাম প্রচার করেন তারা সুফিবাদনির্ভর ওয়াজ করেন। আরেক পক্ষ তাদের সহ্য করতে পারেন না। খুব নিচু ভাষায় তাদের আক্রমণ করেন। সে সব আক্রমণের উত্তর দিতে গিয়ে সুবিবাদীরাও কম যান না। পাল্টা আক্রমণ করেন। যে সব বক্তা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত তারাও অভিন্ন কাজ করেন।

ওয়াজের নামে নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রচার করেন। রাজনৈতিক বিরোধীদের আক্রমণ করতে গিয়ে এত নিচু লেভেলে নেমে কথা বলেন যা কোনো সভ্য সমাজে আলোচনা করা যায় না।

নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, পদা, জিকির আজকারের মতো মৌলিক ইবাদত নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেন।

অথচ ওয়াজ নসিহত হওয়া উচিৎ ছিল আমলদার হক্কানি আলেমদের মাধ্যমে সহি কোরান হাদিস নির্ভর। রাসুলের (স) সিরাত নির্ভর। সাহাবিদের জীবনী নির্ভর। নৈতিকতা নির্ভর। আদব, তমিজ, সভ্যতা নির্ভর। কোমল, মোলায়েম, হৃদয় স্পর্শী। কিন্তু তা হচ্ছে না।

আমি মনে করি ওয়াজের নামে বর্তমান সময়ের তরুণ যুবক আলেমরা খুব কুৎসিত পথে ধাবিত হয়েছেন। নোংড়া প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছেন। এই ধারা থেকে এখনি বেরিয়ে আসা দরকার। পরিবর্তন দরকার। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে কিছু সজ্জন মানুষের এগিয়ে আসা দরকার।

না হলে অচিরেই বাংলাদেশে দীন প্রচারের এই মহতি ধারা বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষ ওয়াজ নসিহতের মজলিস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। যা হবে সমাজ, নৈতিকতা ও পরকালের জন্য চূড়ান্ত রকমের ক্ষতিকর।

দেশের হক্কানি আলেমগণ এগিয়ে আসতে পারেন। ওয়াজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করা যেতে পারে। যেখানে শিক্ষিত আলেমদের বিষয়ভিত্তিক ওয়াজ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ওয়াজের আদব, মজলিসের আদব শেখানো হবে। ওয়াজের অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত শব্দযন্ত্র ব্যবহার করে শব্দদূষণ বিষয়ে সচেতন করা হবে।

আবাসিক এলাকায় বেশি রাত পর্যন্ত ওয়াজ করে রোগী-শিশুদের ক্ষতি না করার বিষয়ে সচেতন করা হবে। অর্থাৎ ওয়াজের পরিবেশ বান্ধব, সমাজ বান্ধব, শ্বাস্থ্য বান্ধব দিক শেখানো হবে। ওয়াজের মাধ্যমে উপার্জনের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। ইনকাম ট্যাক্সের আওতায় এর আইনগত বৈধতা বোঝানো হবে।

শুধু প্রশিক্ষিত আলেমরাই ওয়াজ-নসিহত করতে পারবেন। কেউ ভুল তথ্য দিলে, ভুল ফতোয়া দিলে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করে বরং সঠিকটা সহজ করে তুলে ধরতে হবে। শুধু সঠিক বিষয় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেও যে অন্যের কথার বা ভুলের উত্তর দেয়া যায় এই ধারণা কায়েম করতে হবে।

তাতেও কাজ না হলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এভাবেই চিৎকার-চেঁচামেচি করা, অদরকারী কেচ্ছা-কাহিনী বলা, অন্যকে আক্রমণকারী, ওয়াজের পরিবেশ নষ্টকারীদের সরিয়ে দিতে হবে। ওয়াজ-নসিহতের সঠিকরূপ ফিরিয়ে আনতে হবে। অতীতের মতো বর্তমানেও ওয়াজকে সমাজ সংস্কারের অন্যতম মাধ্যম বানাতে হবে। অন্যথায় দীন প্রচারের এই মহতী সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।




error: Content is protected !!