ভারতের সাম্প্রতিক আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে বেশ কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। এবারের মুভমেন্ট অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত। বামপন্থি ছাত্রদের কিছু ভূমিকা প্রাথমিকভাবে ছিল। তবে তা ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক। জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে বা জামিয়া মিলিয়ায় ইতস্তত বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছিল। তবে তা এতই ছোট আকারের যে বিজেপির পক্ষে তা সামাল দেওয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। আসলে বিজেপি, এমনকি আমরাও যারা নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলে দাবি করি তারাও বুঝতে পারিনি যে কত ক্রোধ ভেতরে ভেতরে ভারতের আমজনতার বুকে জমা হচ্ছিল। কিন্তু তাকে সংগঠিত করার শক্তি সেভাবে চোখে পড়ছিল না। ইঙ্গিত একটা ছিল। তা নিয়ে বেশ কয়েকবার লিখেছিও। ছত্তিশগড়, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড এমনকি দক্ষিণপন্থি রাজনীতির গড় মহারাষ্ট্রে বিজেপি কোণঠাসা হওয়ার পর থেকে এটা বোঝা যাচ্ছিল যে বিজেপি ও তার সহযোগীরা অপরাজেয় নয়। এই কিঞ্চিত বে-কায়দায় পড়া শাসকদের চেহারা নিজেদের সহযোগী দলগুলো টের পেয়ে গিয়েছিল।
আর কথাই আছেÑ হাতি যখন কাদায় পড়ে ব্যাঙেও তাকে লাথি মারে। ফলে মহারাষ্ট্রে দীর্ঘদিনের সহযোগী শিবসেনা বিজেপির নেতৃত্বাধীন ফ্রন্ট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা এনডিএ ছেড়ে কংগ্রেস ও শারদ পাওয়ারের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার করতে খুব বেশি দ্বিধা করেননি। এনআরসি বা সিএএ নিয়েও বিজেপি সহযোগীদের মধ্যে মতভেদ স্পষ্ট। ওড়িশায় নবীন পট্টনায়ক বা বিহারের নীতিশ কুমার কেউই একবাক্যে বিনা প্রশ্নে নাগরিক সংশোধনী আইন মেনে নিতে রাজি নন। পাঞ্জাবের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী আকালি দল শুধু বিরোধিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সিএএ নিয়ে তাদের আপত্তি এতটাই প্রবল যে আসন্ন দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে তারা বিজেপির সঙ্গে কোনোরকম জোটে না গিয়ে একক লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।
এ ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার যে বাইরে থেকে যতই ঝা-চকচকে লাগুক না কেন ভেতরে ভেতরে বিজেপিরও চুন-সুরকির পলেস্তরা খসছে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ দুটো। ১. বিপর্যস্ত অর্থনীতি ২. বিভাজনের রাজনীতি। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা দখলের পর থেকে অসহিষ্ণুতা যে চরমে উঠেছে, তা প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে-আবডালে তার অতি কট্টর সমর্থকও এটা স্বীকার করবে। এমন একটা দিন নেই যেদিন কোথাও না কোথাও মানুষকে নিগৃহীত করা হয়েছে স্রেফ ধর্মের কারণে। একদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদের হুঙ্কার অপরদিকে মুসলিমবিদ্বেষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর মনে চাঙ্গা করে ভোটে জেতা এই দ্বিমুখী নীতি ছিল বিজেপির একমাত্র সম্বল। মুশকিল হচ্ছে এই গুজরাত মডেল যে সারা জীবন কাজে লাগবে না, এটা বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্কেরা বুঝতে পারেননি। একটা স্ফুলিঙ্গ থেকেই যে দাবানল সৃষ্টি হতে পারে তা নতুন করে প্রমাণ হচ্ছে ভারতের মাটিতে। সংসদীয় গণতন্ত্রের নানা মারপ্যাঁচ, হিসেব-নিকেশ আর শাসকদের লাল চোখের পরোয়া না করে আন্দোলন নেমে এসেছে প্রকাশ্যে রাজপথে। সেই আন্দোলনের নেতা কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তি নয়। আমজনতাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নেতানেত্রীরা যাচ্ছেন। সমর্থনও অনেকেই করছেন। কিন্তু তারা সবাই এ লড়াইয়ে স্রেফ পার্শ্বচরিত্র। নায়ক নন।
নায়ক নিঃসন্দেহে অজানা অখ্যাত সাধারণ মানুষ। তথাকথিত অশিক্ষিত হতদরিদ্র জনতা ইতিহাস সৃষ্টি করছে। একের পর এক কালো আইন জারি করে, পুলিশ মিলিটারি নামিয়েও এখনো পর্যন্ত আমজনতার লৌহকঠিন মানসিকতায় চিড় ধরাতে পারেনি মোদি সরকার। যতদিন যাচ্ছে সমস্ত রাস্তা মিলিত হয়ে উঠেছে একমাত্র রাস্তায়। এমন গণ-আন্দোলন স্বাধীনতার পরে কখনো ভারত দেখেনি। শিশু কোলে মা অনশনে বসছেন শীতের ঠাণ্ডায়। বস্তির তরুণী আর জে এন ইউ-এর স্মার্ট তরুণ হাত ধরাধরি করে আওয়াজ তুলছে ‘আওয়াজ দো হাম এক হো’। একই সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে নেরুদা, লোরকা ও ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতা। হিন্দু মুসলমান শিখ মিলেমিশে শামিল হচ্ছেন মানববন্ধন বা মশাল মিছিলে। ধুলো পায়ে শতচ্ছিন্ন পোশাকে শীতের রাতে তেরঙা ঝান্ডা ওড়াতে ওড়াতে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের পাঠ দিচ্ছে এক মুসলিম কিশোর। পাশেই উদ্ভাসিত তার বন্ধু এক ছাপোষা হিন্দু কিশোর। এই ভারতে দাঙ্গা বাধানোর সাধ্য কারও নেই। ভারত এখন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। কে জিতবে এখনই বলা কঠিন। ফ্যাসিবাদী শাসক না ধর্মনিরপেক্ষ জনতা! কিন্তু একটু একটু করে শাসক যে পিছু হটছে তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।
আপাতভাবে আপনি প্রশ্ন তুলতেই পারেন, পিছু হটার কোনো লক্ষণ তো দেখছি না। কিন্তু খুব খুঁটিয়ে দেখুন, দেখবেন অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদি থেকে বিজেপির চুনোপুঁটি নেতাদের শরীরের ভাষায় কয়েক মাসে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। একেক জায়গায় তারা একেক কথা বলছেন। কেউ বলছেন জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি নিয়ে কোনো কথাই হয়নি। অপরজন হুমকি দিচ্ছেন যে সারা দেশে এনআরসি হবেই। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের নেতারা তো অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করছেন আন্দোলনকারীদের। এই শারীরিক ভাষা কোনো সুস্থ বার্তা দেয় না। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি আর সাম্প্রদায়িক স্বৈরতন্ত্রের প্রবক্তাদের মধ্যে ভারতের রাজনীতি এখন পুরোপুরি বিভক্ত হয়ে গেছে।
তবে এবারের লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা দলে দলে মুসলিম মেয়েদের অংশগ্রহণ। অর্ধেক আকাশ হয়ে এই মেয়েরা আজ ভারতকে আগলে রেখেছে যাবতীয় অন্ধকার, ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে। এ গল্প তাই শুধু লড়াই, সংগ্রামের নয়। এ কাহিনী প্রবল উদ্দীপনা সৃষ্টিরও। যে সারি সারি মুখগুলো না খেয়ে দিনের পর দিন প্রবল রাষ্ট্রীয় হুমকির মধ্যে দাঁড়িয়ে দেশের পতাকা ওড়াচ্ছে, তার চেয়ে বড় স্বাধীনতা সংগ্রামী আর কে আছে? বিজেপির রাজনীতির অন্যতম স্তম্ভ পুরুষতান্ত্রিক পিতৃতন্ত্র। পাশাপাশি আন্দোলন গড়ে তুলেছেন মূলত একদা অন্তঃপুরবাসিনী গরিব মেয়েরা। পিতৃতন্ত্রের মুখে চপেটাঘাত করে তারা গেয়ে উঠেছে আজাদির গান। এ আজাদি যাবতীয় গোঁড়ামি থেকে, বদ্ধ জলাশয় থেকে বেরিয়ে আসার আজাদি। মনে পড়ছে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় এক বৃদ্ধা আমাকে শুনিয়েছিলেন ‘ভাইজান, জানকি ময়দান মে বোরকা কা কিয়া জরুরত হায়!’ অর্থাৎ লড়াইয়ের ময়দানে পোশাক কোনো বাধা হতে পারে না ।