সাম্প্রতিক অতীতের বেশ কয়েকটি নির্বাচনের মতোই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থীদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের খবর মিলেছে। কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরাও পিছিয়ে নেই। কয়েকজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও প্রচার অভিযানে অংশ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। উত্তর সিটির মেয়র পদপ্রার্থী আতিকুল ইসলামের নির্বাচনী জনসভায় উপস্থিত থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা-১৩ আসনের সংসদ সদস্য মো. সাদেক খানের বিরুদ্ধে। মিছিল ও শোভাযাত্রা করে আচরণবিধি লঙ্ঘন করার অভিযোগ রয়েছে ঢাকা উত্তরে বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের বিরুদ্ধেও। নির্বাচনী প্রচার শুরুর দিনে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদের সামনে বিএনপির কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক তার পক্ষে রাস্তা আটকে মিছিল করে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধে বিচার বিভাগীয় ও নির্বাহী হাকিমদের ভূমিকাও দৃশ্যমান নয়। পাশাপাশি, প্রার্থীদের প্রচার অভিযান নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। প্রার্থীদের প্রচারে ব্যাপক মাত্রায় পলিথিনে মোড়ানো বা লেমিনেটেড পোস্টার ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে, যা নগরের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বুধবার দেশ রূপান্তরে প্রকশিত ‘পলিথিনমোড়া প্রতিশ্রুতি’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেয়র প্রার্থী থেকে শুরু করে কাউন্সিলর প্রার্থীরাও পলিথিনে মোড়া পোস্টারে প্রচার চালাচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারে পলিথিনের এমন প্রচার দেখে মনে হবে যেন নিষিদ্ধ পলিথিন বৈধতা পেয়েছে। কর্মী ও সমর্থকদের যুক্তি, বৃষ্টি ও কুয়াশার পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যায় পোস্টার। তাই তারা পলিথিনমোড়া পোস্টার দিচ্ছেন যাতে তা নষ্ট না হয়। কিন্তু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পলিথিনের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই নিষিদ্ধ। ২০০২ সাল থেকে সরকার পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশে পরিবহন ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর পলিথিনের ব্যবহার নিয়ে ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে উল্লেখ করা হয়, পলিথিন বিভিন্নরূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই পলিথিনে মোড়ানো পোস্টারের ব্যবহার স্পষ্টত সরকারি আদেশের লঙ্ঘন এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পলিথিন ব্যবহারের ফলে ড্রেন, নালা-নর্দমা, ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক নর্দমায় গিয়ে জমা হয়ে বর্ষায় জলাবদ্ধতার কারণ হয়। এছাড়া পলিথিনের ক্ষুদ্র কণা ভেঙে যাওয়ার পর সেগুলো মাছ ও অন্যান্য প্রাণী খায়। এভাবে ফুড চেইনের মাধ্যমে ক্ষতিকর পলিথিন আমাদের দেহে প্রবেশ করছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। পলিথিনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে প্রার্থীরা ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও তারা তা ঢালাওভাবে ব্যবহার করছে। নির্বাচন কমিশনও কেন এ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে আমলে নেয়নি তা বোধগম্য নয়। এক্ষেত্রে তাদের বিশেষ মনোযোগ প্রত্যাশিত ছিল।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় লেমিনেটেড পোস্টার ছাপা ও প্রদর্শন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রতিবেদন নজরে এনে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাইলে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ বুধবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ এ আদেশ দেয়। সারা দেশে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে লেমিনেটেড পোস্টার ছাপা এবং প্রদর্শন বন্ধে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন কমিশনের সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সচিব, শিল্প সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
শুধু পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার ব্যবহারই নয়, জনজীবনের ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী অনেক তৎপরতাও নির্বাচনী প্রচারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা-২০১৬ বলছে, দুপুর ২টার আগে এবং রাত ৮টার পরে মাইক বা শব্দের মাত্রা বর্ধনকারী অন্য যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু গভীর রাত পর্যন্ত মাইক ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিধিমালায় আরও আছে, জনগণের চলাচলের বিঘœ সৃষ্টি করতে পারে, এমন কোনো সড়কে পথসভা বা মঞ্চ তৈরি করা যাবে না। কিন্তু প্রায় কোনো প্রার্থীই এ বিধি মানছেন না। কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের পোস্টারে দলীয় প্রধানের ছবি নিষিদ্ধ হলেও সে নিষেধ মানা হচ্ছে না। নিষেধ থাকলেও মসজিদগুলোতে লিফলেট বিতরণ চলছে। প্রতিপক্ষের প্রচারাভিযানে বাধা সৃষ্টি, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, প্রতিপক্ষকের ওপর হামলাসহ নানা অভিযোগ উঠছে প্রতিদিনই।
জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে নির্বাচনী প্রচার অভিযান কখনোই কাম্য নয়। যারা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তারা সবাই নগর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে জনজীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার ব্যবহার করা এই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি, নির্বাচন কমিশনেরও এ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট দায়দায়িত্ব রয়েছে। তাই পলিথিনে মোড়ানো পোস্টারের বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে চলার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী প্রচার যাতে জনগণের কষ্টের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সেটা মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা এবং নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে।