পল্লী অঞ্চলের নর-সুন্দরদের দুর্দিন

প্রকাশিত: ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৫, ২০২০

আহমেদ রুবেল শিবগঞ্জ (বগুড়া) প্রতিনিধিঃ পল্লীর নর-সুন্দরদের দুর্দিন চলছে। বিলাসবহুল সেলুনের কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে অনেকেই তাদের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ছুটছে।
এক সময়ে গ্রাম এলাকার নর-সুন্দরদের বেশ কদর ছিল। হাতেগোনা দু-একজন বাদে গ্রামের প্রায় লোকজনই সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নর-সুন্দরদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। গ্রামাঞ্চলে এদের রয়েছে আঞ্চলিক নাম নাপিত।
আগের দিনে দোকান বা বাজার নয় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নাপিতরা চুল কাটতেন। নাপিত বাড়িতে আসার কথা শুনলেই বড়-ছোট সকলেই নাপিতের কাছে ভিড় জমাতেন। বাড়ির কোনে গাছের ধারে নাপিত একটি টুল পেতে আসন বসাতেন। নাপিত মাজায় গামছা বেঁধে তৈরি হতেন। কে আগে আর কে পরে চুল কাটবে তা নিয়ে হুড়াহুড়ি পড়ে যেত। ছোট-বড় সকলেই চুল কাটার জন্য টুলের ওপর বসলে নাপিত মাঝারি ধরনের একটি কাপড় গায়ের ওপর দিয়ে গলার নিচে বেঁধে দিতেন। নাপিত চুলের ওপর হাত বুলিয়ে চিরুনী লাগিয়ে কাঁচি দিয়ে চুল কাটা শুরু করতেন।
কেঁচির ক্যাঁচ-কু্চঁ আওয়াজের সাথে নাপিতেরা গান ধরতেন। গানের তালে তালে হাত চালাতেন নর-সুন্দররা। ছোট্ট ছেলে-মেয়েরা চুল কাটতেন এক রকম করে। যুবকরা কাটতেন হরেক রকমের ডিজাইনের কথা বলে। বুড়োরা মাথায় সমান করে ছোট ছোট করে চুল কাটাতেন। নাপিত চুল কাটতে কাটতে মাঝে মধ্যে কাঁচি-চিরুনীর সাথে বাড়ি দিতেন। সেই সঙ্গে চুল সমান করার জন্য পুরাতন ইমেজের একটি বড় ক্ষুর রাখতেন। ক্ষুর চামড়ার বেল্টের সাথে ঘষে ধার তুলতেন এবং কানের কলিসহ মাথার চুলের চারিধারে সমান করে পরিষ্কার করতেন। চুল কাটার সাথে বয়স্করা আবার অনেই দাড়ি কামাতেন। দাড়ি কামানোর জন্য নাপিত মুখে সাবান ঘষে দিতেন এবং বেশকিছু সময় মুখে মালিশ করার পর ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কাটার কাজ করতেন। কাজ শেষে যে যা পারে বখশীশ দিতো তা দিয়েই নাপিতরা বিদায় নিতেন। মাসের প্রায় শেষের দিকে নাপিতরা গ্রামের সকল বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এভাবেই চুল কাটতো। বছর ঘুরে ধানের মওসুম এলে গ্রামের নর-সুন্দররা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ধরনা দিতেন। প্রতি বাড়ি হতে ধান চাল আদায় করতেন। এভাবেই তারা রোজগার করতেন এবং চালাতেন তাদের সংসার।
এখন আর আগের মতো নেই। আগের মতো মানুষ আর গ্রামের নর-সুন্দরদের কাছে টুলে বসে চুল কাটেন না। গ্রামের নাপিতদের আর কেউ বাড়িতে ডাকেন না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সবকিছুতে পরিবর্তন এসেছে। এ ছোঁয়া লেগেছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। গ্রামের মোড়ে মোড়ে, হাট-বাজারে, শহরে স্থাপিত হয়েছে অনেক উন্নত মানের সেলুন। সেসব সেলুনে বসেই লোকজন চুল কাটায়। গ্রামের লোকেরা এখন উন্নত রেজারে ভালো মানের ফোম দিয়ে বাড়িতে বসেই সেভ করে।
গ্রামের মানুষও সেলুনমুখী হওয়ায় পল্লীর নর-সুন্দরদের কাছে আর কেউ কাজ করতে চান না। বয়স্ক দু-একজন গ্রামের নাপিতের কাছে কাজ করলেও তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। ফলে গ্রামের নর-সুন্দর, নাপিত এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
এ ব্যাপারে কথা হয় কয়েকজন নাপিতের সাথে তারা জানান, দীর্ঘদিন বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ছিলাম। এখন আর আমাদের কাছে কেউ চুল কাটেন না। তাই এ পেশা ছেড়ে অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছি ।




error: Content is protected !!