রোজা শুরুর আগে চট্টগ্রামের ৩৫ জন আমদানিকারক মিলে ৩ হাজার ১৪৩ দশমিক ৯৫ মেট্রিক টন আদা আমদানি করেছেন। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সসহ এ আমদানিতে খরচ পড়েছে ২৫২ কোটি ৬১ লাখ ৭ হাজার টাকা। খুচরায় প্রতি কেজি আদার দাম পড়েছে ৮০ টাকা। অথচ ৮০ টাকার সেই আদা খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ২৫০ ও নগরের বাজারগুলোতে খুচরা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা।
রোববার (২৬ এপ্রিল) দুপুরে দেশের খাদ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও র্যাব। অভিযানে আমদানিকারক, কমিশন এজেন্ট এবং ব্রোকারদের যোগসাজশে আদার মূল্য বৃদ্ধির প্রমাণ পেয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে নেতৃত্ব দেন- নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম এবং মো. আলী হাসান।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাইকারি ও খুচরা বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীরা পরস্পর যোগসাজশে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশি রাখছে। এসব অভিযোগে রোববার ১০টি মামলায় মোট ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি দাম রাখায় হামিদুল্লাহ মার্কেটের কামাল উদ্দিন ব্রাদার্সকে ৫০ হাজার টাকা, পাহাড়তলী বাজারে এক ব্যবসায়ীকে অতিরিক্ত দামে আদা বিক্রি ও আদা ক্রয়ের রশিদ না থাকায় ১০ হাজার টাকা ও আরও পাঁচজন ব্যবসায়ীকে মোট ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘খাতুনগঞ্জ বাজারে অভিযানে দেখা গেছে, আদার আড়তগুলোতে আমদানি মূল্যের চেয়ে তিনগুণ বেশি দামে আদা বিক্রি হচ্ছে। হাতেনাতে বেশি মূল্যে আদা বিক্রির প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমদানি তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ৩ হাজার ১৪৩ দশমিক ৯৫ মেট্রিক টন আদা আমদানি করেছেন চট্টগ্রামের ৩৫ জন আমদানিকারক। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সসহ আমদানি খরচ পড়েছে ২৫২ কোটি ৬১ লাখ ৭ হাজার টাকা। খুচরায় প্রতি কেজি আদার দাম পড়েছে ৮০ টাকা। অথচ ৮০ টাকা সেই আদা খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে ২৫০ ও নগরের বাজারগুলোতে খুচরায় প্রতি কেজি আদার দাম নেয়া হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশ থেকে যে আদা আমদানি হয়েছে সেগুলোর কেজি প্রতি মূল্য ৯০-৯৫ টাকার মতো।
এ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘গত ১৫ এপ্রিলের পর থেকে আদা ব্যবসায়ী চক্র (আমদানিকারক, ব্রোকার, কমিশন এজেন্ট ও আড়তদার) এর মূল্য বাড়িয়ে ১২৫ টাকা থেকে কয়েক দিনের ব্যবধানে ২৫০ টাকার উপরে নিয়ে গেছেন। আমদানিকারকরা বন্দর থেকে সরাসরি দালাল (ব্রোকার), কমিশন এজেন্টদের মাধ্যমে আড়তদারদের নিকট এসব পণ্য পৌঁছে দেন। মূলত, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে আদার বাজার অস্থিতিশীল করার পেছনে রয়েছেন কতিপয় আমদানিকারক এবং ব্রোকার (দালালদের)।
অপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলী হাসান বলেন, ‘আজ আমরা অভিযান শুরুর পর খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ বাজার, নবী সুপার মার্কেট, আমির মার্কেট, ইয়াকুব বিল্ডিং এবং চাক্তাই এলাকার বেশ কিছু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান তাদের অফিস বন্ধ করে গা ঢাকা দেয়। এদের মধ্যে যে সকল প্রতিষ্ঠান গা ঢাকা দিয়েছে তাদের অধিকাংশই আদা ব্যবসায়ী।
তিনি জানান, বিভিন্ন পাইকারি দোকান, আড়ত ও মোকামে বিক্রেতাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আদার আমদানিকারকদের সঙ্গে একটি দালাল (ব্রোকার) এবং কমিশন এজেন্ট চক্র যুক্ত হয়ে এর মূল্য বৃদ্ধিতে কারসাজি করেছে।
আদার বাজারে কারসাজি করছে কারা?
জেলা প্রশাসনে অনুসন্ধানে মোট ৩২ জন ব্যবসায়ী ও দালালদের নাম উঠে এসেছে, যারা আদার বাজারে কারসাজি করছে। সেই তালিকাটির একটি কপি এসেছে জাগো নিউজের হাতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাতুনগঞ্জে বিভিন্ন সময় আমদানিকারকদের সঙ্গে চক্র করে যারা বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- আজিজ (মোবাইল-০১৮১৯-৩২৯৯৮৩), জিয়াউর রহমান (মোবাইল-০১৮২৩-৭১৭৭৪৭), সিরাজ ও কাদের।
গত বছর চট্টগ্রামে পেঁয়াজের বাজার মূল্য অস্থিতিশীল করার পেছনে জিয়াউর রহমানের যোগসূত্র ছিল। জিয়াউর রহমান একজন আমদানিকারকও। খাতুনগঞ্জে আজকের অভিযানে হাজী সোনা মিয়া মার্কেটে গিয়ে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ দেখতে পায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রশাসনের উপস্থিতিতে টের পেয়ে তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন।
চট্টগ্রামের যেসকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গত চার মাসে আদা আমদানি করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে- খাতুনগঞ্জের ফরহাদ ট্রেডিং, মেসার্স ইউনিভার্সেল অ্যাগ্রো করপোরেশন, মেসার্স জিয়াউর রহমান, মেসার্স সাবরিন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স আজাদ সিন্ডিকেট, মেসার্স বাশার মোল্লা অ্যান্ড কোম্পানি, ইউসুফ করপোরেশন, মেসার্স মনির এন্টারপ্রাইজ, এ এস ট্রেডিং কোম্পানি, মেসার্স কাদের অ্যান্ড সন্স, মেসার্স আবরার ট্রেডিং, এ মুক্তার ট্রেডিং, মেসার্স খাতুনগঞ্জ ট্রেডিং, মেসার্স রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ।
এনায়েতবাজার জুবিলী রোডের ওকেএম ট্রেডিং করপোরেশন, এফ এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, শাহ আলম সওদাগর ও মেসার্স কে এন ইন্টারন্যাশনাল।
আরও যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে- আসাদগঞ্জের মেসার্স জামশেদ এন্টারপ্রাইজ, কাজেম আলী রোডের মেসার্স সাউদার্ন ট্রেডিং, রিয়াজুদ্দিন বাজারের এ এইচ এন্টারপ্রাইজ, ও এস ট্রেডার্স, খলিল এন্টারপ্রাইজ, নতুন চাক্তাইর সাইদুল এন্টারপ্রাইজ, কোতোয়ালির অর্ণব অ্যান্ড অরিত্রী জেনারেল ট্রেডিং এবং আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার আবরার ট্রেড, আল-হোসেন ট্রেডিং, আর পি এস ইন্টারন্যাশনাল, এম কে ট্রেডিং, সাকি ইন্টারন্যাশনাল ও গ্রিন ট্রেড।
এদিকে নগরের গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়তলি এবং ফইল্যাতলি বাজারে অভিযান পরিচালনা করেন আগ্রাবাদ সার্কেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সামাদ শিকদার।