মোঃ ইউসুফ শেখ, খুলনা প্রতিনিধিঃ
কভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস সারাবিশ্বের মানুষের মাঝে এক মুর্তিমান আতঙ্ক। প্রতি মুহুর্তে বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্তে কেউ না কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমাজনের গভীর জঙ্গলেও পৌছে গেছে করোনা। করোনায় মৃত্যু এবং আক্রান্তের হিসেবে এখন সেকেন্ডেই করছে ওয়ার্ল্ডোমিটার। বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু এবং সনাক্তের হার অনেক কম হলেও মোট আক্রান্তের দিক থেকে শীর্ষ তালিকায় অবস্থান করে নিয়েছে।
চলতি বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথম সনাক্ত হলেও আতঙ্কটা বাংলাদেশে এসেছে একেবারের জানুয়ারির শুরুতে। আর তখন থেকেই সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে যারা বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আসছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন স্থানীয় সরকারের একেবারের তৃণমূলের অর্থ্যাৎ ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা।
তেমন এক তৃণমূলের সম্মুখ করোনাযোদ্ধা মিসেস কেয়া (কেয়া মেম্বর)।
খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়নের ৭, ৮, ৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা আসনের নারী ইউপি সদস্য মিসেস কেয়ার বেড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরিজীবী বাবার পরিবারের দুই বোনোর মধ্যে মিসেস কেয়া এখন ফুলতলা উপজেলার সব থেকে পরিচিতি ইউপি সদস্য। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে কেয়ার হাতেখড়ি উচ্চ মাধ্যমিকের সময়। স্থানীয় মহিলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি বিলকিস আক্তার ধারার হাত ধরেই রাজনীতিতে পথচলা শুরু যে কেয়ার, তিনি এখন ফুলতলায় ‘করোনা আপা’ হিসেবে সুপরিচিতি।
ফুলতলা উপজেলা থেকে নারী ইউপি সদস্য হিসেবে জেলায় বেশ সুপরিচিতি রয়েছে মিসেস কেয়ার। দামোদর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবে হিসেবে পুরো ইউনিয়ন এমনকি পুরো উপজেলার নারীদের জন্য শুরু থেকে নানাভাবে কাজ করে চলেছেন তিনি।
ফুলতলা উপজেলায় প্রথম করোনা সনাক্ত হওয়ার পর থেকে কেয়ার ঘুম যেন হারাম হয়ে গেছে। দেশে প্রথম করোনা সনাক্ত হওয়ার পর বিশেষ করে মার্চের শেষের দিকে সরকারি সাধারণ ছুটি ঘোষনার পর ঢাকা বা তার আশপাশের জেলা থেকে ফুলতলা তথা দামোদর ইউনিয়নে কোনো বাসিন্দা গ্রামে ফিরলে তার ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার গুরু দায়িত্ব পড়ে মিসেস কেয়ার ওপর। প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসেবে পুলিশের সঙ্গে তালমিলিয়ে পুরো উপজেলায় বাইরে থেকে আগত ব্যক্তি বা পরিবারের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার জন্য এক বাড়িতে দিনে তিনবারও হাজিরা দিয়েছেন মিসেস কেয়া। কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যে কোনো প্রয়োজনে তিনি ২৪ ঘন্টায় প্রস্তুত থেকে তাদেরকে সহযোগিতা করেছেন।
আধুনিক চিন্তা চেতনায় উদ্ভুদ্ধ কেয়া ব্যক্তিজীবনে এক সন্তানের জননী। সিঙ্গেল প্যারেন্টস হিসেবে ছেলে কামিল মোস্তাফা বা পরিবারের নিরাপত্তার কথা না ভেবে রাত দিন তিনি সম্ভাব্য করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির বাড়িতে গেছেন। তাদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে গিয়ে কিছুটা হেয় প্রতিপন্নও হয়েছেন কখনো কখনো। তবে সবার আগে ইউনিয়নের সব মানুষকে করোনা থেকে সুরক্ষিত রাখতে তিনি সার্বক্ষনিক সচেস্ট থেকেছেন। আর সে কারণেই তিনি দামোদর ইউনিয়ন তথা পুরো ফুলতলা উপজেলাতে ‘করোনা আপা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
করোনার শুরু থেকে সরকারি ত্রান বিতরণের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ভাবে নিজ ওয়ার্ডের গরিব-অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করতে বাড়ির গাছ পর্যন্ত বিক্রি করেছেন মিসেস কেয়া। বাবা মায়ের অনুপ্রেরণায় মানুষের জন্য সেবার ব্রত নিয়ে পথচলা কেয়ার নেশা এখন করোনা থেকে পুরো ইউনিয়নকে মুক্ত করা।
ইউনিয়নের প্রতিটি প্রান্তে চায়ের দোকান বা অন্যান্য স্থানে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করাসহ সরকার নির্ধারিত সময়ের বাইরে মানুষকে ঘরে আবদ্ধ রাখতে আপ্রাণ চেস্টা করে যাচ্ছেন মিসেস কেয়া।
গত মঙ্গলবার গভীর রাতে একটি মোটরসাইকেল বহরকে সন্দেহবশত ফলো করে কেয়ার এহন কাজের চাক্ষুস প্রমাণ মেলে প্রতিবেদকের কাছে। দামোদর ইউনিয়নে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক মধ্যবিত্ত পরিবারকে গভীর রাতে আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা দিতে গিয়েছিলেন কেয়া তার সঙ্গীদের নিয়ে। ফিরে আসার পথে কথা হয় কেয়ার সাথে প্রতিবেদকের। জানতে চাওয়া হয় কেন তিনি এত গভীর রাতে বের হয়েছেন। প্রতিউত্তরে সদাসয় উত্তর, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারকে লোক চক্ষুর আড়ালেই সহযোগিতা করছেন তিনি।
আসতে আসতে জানা যায়, ফুলতলার করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে সবথেকে বেশি যে জনপ্রতিনিধিকে পাওয়া গেছে নাম তার ‘মিসেস কেয়া’। সংখ্যার বিচারে ফুলতলা উপজেলায় ‘সাহা পাড়া’য় সবথেকে বেশি করোনা সংক্রমিত ব্যক্তি বা পরিবার রয়েছেন। ঐ সমস্ত করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির পারিবারিক সকল প্রয়োজনে একমাত্র ভরসার নাম ‘মিসেস কেয়া’। সাহা পাড়ায় প্রথম করোনা সংক্রমিত ব্যক্তি ‘সুমন সাহা’। ফুলতলার কাপড় ব্যবসায়ী সুমন সাহা প্রতিবেদককে জানান, ‘করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেয়া থেকে সেরে ওঠা পর্যন্ত নিজ পরিবারের থেকেও যে ব্যক্তির কাছ থেকে সবথেকে বেশি মানষিক শক্তি পেয়েছেন তিনি হলেন মিসেস কেয়া। বাসার বাজার থেকে শুরু করে ব্যবসা সামলানোর সার্বক্ষনিক পরামর্শ তিনি পেয়েছেন কেয়া এবং তার সঙ্গীদের কাছ থেকে। এমন উদাহরণ পুরো ইউনিয়নজুড়ে।
লকডাউনে পড়ে গরীব অসহায় মানুষের পাশে যেমন ছিলেন কেয়া তেমনিভাবে করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির পাশেও থাকছেন তিনি। ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা জানান, নিজ ওয়ার্ডের মেম্বর বা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে পাশে না পেলেও কেয়া মেম্বারকে তারা সবসময়ে পাশে পেয়েছেন। যে কোনো প্রয়োজনে কেয়া মেম্বারকে ফোন করলে তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে তাদের পাশে এসে দঁাড়িয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে মিসেস কেয়াকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মানুষের ভোটে আমি নির্বাচিত। বিপদে তাদের পাশে দঁাড়ানোর জন্য আমার আদর্শ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি যতদিন বঁাচবো ততদিন মানুষের সেবা করে যাবো। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে দেশের তথা জনগণের সেবা করার সুযোগ যেহেতু আমার হাতে আছে সবার ভালোবাসা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।
করোনায় নিজেকে এভাবে উজাড় করার কারন জানতে চাইলে বা সন্তানের নিরাপত্তার কথা বলতেই তিনি বলেন, আমি ক্ষতিগ্রস্থ হলে আমার সন্তান হবে সবার সন্তান । তবে আমি মানব সন্তান হিসেবে মানবের সেবা করা আমার প্রধান কর্তব্য। সে কারনেই আমার এই ছুটে চলা। মানুষের সেবা করা বা সহযোগিতার মধ্যেই আমি সবথেকে বেশি সুখ অনুভব করি। বাবা মায়ের ভালোবাসা এবং অনুপ্রেরণা আমাকে মানুষের সেবা করতে উৎসাহিত করে।