সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম এবং সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে একটি বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শরিয়ত বয়াতীর গ্রেপ্তার, তাকে রিমান্ডে নেওয়া এবং বিনাবিচারে এখনো কারাগারে অবস্থান। বিষয়টি আপাতত কেউ হালকাভাবে নিলেও এখানে কিছু চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তা হলো যারা নাচ, গান, নাটক, চিত্রকলা ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত আছেন তাদের কাছে বিষয়টি ভীতিকর। এবং এই ভীতি থেকে তারা ভাববেন কোনটা করা যাবে আর কোনটা করা যাবে না। সৃজনশীল শিল্পীদের একটা দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিতে পারলে এক পক্ষের খুবই লাভ হয়। আমি কোন পক্ষের কথা বলছি তা সবাই বুঝতে পারবেন। সেই পক্ষ দ্বিজাতিতত্ত্বের দর্শন মস্তিষ্কে নিয়ে আছেন এবং তথাকথিত মুসলিম বাংলার স্বপ্ন নিয়ে কল্পনার জাল বুনছেন। যারা প্রকাশ্যে উগ্র মৌলবাদী দলেগুলোর সঙ্গে যুক্ত তাদের আমরা চিনি। কিন্তু যারা মৌখিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে জিন্দাবাদ বলে থাকেন তারাই ভয়ংকর। ১৯৭৫ সালের আগে এই ধরনের লোকরা প্রশাসনে থেকে প্রতিনিয়ত জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে আসছিল। কিন্তু ১৯৭৫ এর পরে তারাই এমনভাবে তৎপর হয়ে উঠল যে জিয়া, এরশাদের সঙ্গে থেকে পনেরটি বছর দেশটি চালিয়ে, হালুয়া-রুটি খেয়ে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।
বয়াতি যা বলেছেন তা নিয়ে একটা তর্ক-বিতর্ক হতে পারত, তাত্ত্বিক আলোচনা হতে পারত, কিন্তু সরাসরি পুলিশি হস্তক্ষেপের পরিবেশ সৃষ্টি হলো কীভাবে? বর্তমান সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে একটি মহৎ কাজ করেছে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, এতে একটা সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে যে কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে সপরিবারে হত্যা করার পরিণাম কী হতে পারে। যেভাবে সরকার কওমি মাদ্রাসা এবং আগুন সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করেছে তাও এক সাহসী তৎপরতা। কিন্তু বাউলদের চুল-দাড়ি কামানো, ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা এইসব ঘটনাকে সরকারের উচিত ছিল কঠোরভাবে দমন করা। একথা ঠিক, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান, কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই অসাম্প্রদায়িক। বাউল, ফকির, সন্ন্যাসী যারাই অসাম্প্রদায়িকতার বাণী প্রচার করে এসেছেন, তারাই মানুষের প্রিয়জন হিসেবে যুগ যুগ ধরে আখ্যায়িত হয়েছেন। লালন, হাছন রাজা, শাহ্ আবদুল করিম, রাধারমন এবং তার সঙ্গে হযরত শাহ্জালাল (রহ.) সম্মানিত হয়েছেন একই কারণে। হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর দরগায় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তির অন্বেষণে উপস্থিত হন। সেখানেও উগ্রবাদীরা শতবর্ষের যে জলজ প্রাণীগুলো মাজারে নির্বিঘেœ অবস্থান করছিল তাদেরও বোমা মেরে হত্যা করেছে। বুদ্ধের মূর্তিতে আঘাত করার মধ্য দিয়ে এক সর্বনাশা উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
বর্তমান সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ আবার ফিরে এসেছে। আবার পাশের দেশ ভারতে হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করে যা করা হচ্ছে তা উসকানিমূলক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেনÑ এই আইন সংশোধন করার কী প্রয়োজন ছিল? প্রচ- শীতের মধ্যে দিল্লিতে শত শত বয়স্ক মুসলিম নারী এই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান করে আসছেন। তাদের বুকভাঙা কান্না সারা ভারতে একটি অযথাই নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আমরা গর্ব করে বলি উপমহাদেশের তিনটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক। ১৯৬৪ সালে শাঁখারী বাজারে একটি দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টাকে রোধ করে একজন পুলিশ অফিসার প্রাণ দিয়েছিলেন। তারপর থেকে এদেশে দাঙ্গা লাগানোর অনেক অপচেষ্টাকে রোধ করা হয়েছে।
শরিয়ত বাউল বলেছেন গান বাজনা যে হারাম তা কোন কিতাবে লেখা আছে? যদি কোনো কিতাবে লেখা থাকে তাহলে তা প্রকাশ্যেই এদেশের আলেম-ওলামারা উল্লেখ করতে পারতেন। ধর্মীয় কুসংস্কার, তা যে ধর্মেরই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে বাউলরা কথা বলে থাকেন। সেটি সমাজের প্রগতিশীলতার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন। এদেশের মানুষ যেমন অসাম্প্রদায়িক, তেমনি যার যার ধর্ম নীরবে তারা পালন করেও যাচ্ছেন। কিন্তু ধর্মের নামে রাজনীতি কেউই পছন্দ করেন না। কারও ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত দেওয়াও অন্যায় বলে মনে করেন। মাঝে মাঝে কিছু দখলপ্রবণ দুর্বৃত্ত এই মৌলবাদী শক্তিকে সঙ্গে করে নিয়ে কিছু ঘটনা ঘটাবার চেষ্টা থাকে বটে, কিন্তু তাদের কোনোভাবে প্রশ্রয় দেওয়া জনগণ বরদাশত করে না। ধর্ম যেমন একধরনের আধ্যাত্মিকতার চর্চা, তেমনি বাউল সম্প্রদায় তাদের মতো করে এক ধরনের আধ্যাত্মিকতার চর্চা করে থাকে। হাজার বছর ধরে সুফিসাধকরা একেবারেই শান্তির পথ ধরে ধর্ম প্রচার করে আসছেন। সেখানে কোনো ধরনের সংঘাত বা চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার কখনোই ছিল না। আলাপ-আলোচনা কিংবা সংগীতের মাধ্যমে তারা ধর্মের বাণী প্রচার করেছেন। চট্টগ্রামের মাইজভা-ারীরা সংগীতকে তাদের চিন্তা প্রচার করার মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। মাইজভা-ারী বলতে আমরা বুঝি এই বাউল-ফকির সম্প্রদায়ের মানুষরা একধরনের সুর এবং গানের বাণী দিয়ে ধর্মের কাজ করে থাকেন। তারা রোজা-নামাজও করেন, ধর্মের নানাবিধ অনুশাসন মেনে চলেন এবং সংগীত তাদের আরেকটি অনুষঙ্গ।
বর্তমান সরকার রাজনৈতিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। এই অঙ্গীকার তাদের বহুদিনের, এমনকি পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই। যখন বোঝা গেল পাকিস্তান স্বাধীনতার নামে একটা বড় ফাঁকি, তখন থেকেই মুসলিম বাঙালিরা বাঙালিত্ব এবং ধর্মকে সমন্বয় করেছে। রোজা, নামাজ, ঈদ, মহররম, শবেবরাত, শবেকদরসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানাদি যেমন করেন, তেমনি পহেলা বৈশাখও উদযাপন করে থাকে। বর্তমানে পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের এক বিশাল বার্ষিক অনুষ্ঠান। এবং উদযাপনের দিক থেকে একটা উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। একসময় গ্রাম-বাংলায় শীতকালে যেমন পিঠার আয়োজন হতো তেমনি যাত্রাপালা, পালাগান, বাউলগানসহ নানা লোকশিল্পের আয়োজন হতো। কিন্তু বর্তমানে সেসব আয়োজন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তার বদলে এক ধরনের বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল এবং স্থানীয় কিছু ব্যান্ড সংগীতের আয়োজন হচ্ছে। অধিকাংশ ওয়াজ মাহফিলে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষকে রীতিমতো আঘাত করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এইসব ওয়াজ মাহফিল ফেইসবুক, ইউটিউবের মাধ্যমে সারা দেশে প্রচারও করা হচ্ছে। এসব কী করে এবং কেন প্রশাসনের নজরে আসে না? তার মানে এখন আগের ধারণাটি পুনরায় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। প্রশাসনের মধ্যে কেউ কেউ এগুলোকে আড়াল করে রাখছে, উৎসাহিত করছে এবং গ্রাম-বাংলার যুবক-তরুণদের বিপথগামী হতে সাহায্য করছে। নানা ধরনের ডামাডোল এবং এক ধরনের লুটপাটকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সংস্কৃতির ফলে প্রগতিশীল জ্ঞানচর্চা ও
সাংস্কৃতিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে তারুণ্য যেভাবে অনুপ্রাণিত হয়, তার অনুপস্থিতিতে একটি ভিন্নধারা তাদের প্রভাবিত করছে। এর মধ্যদিয়েই মাদক ও সন্ত্রাস একটা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। মাদককে কিছুতেই পুলিশ ও প্রশাসন দ্বারা বন্ধ করা যাচ্ছে না। সেটা সম্ভবও না। কারণ মানুষকে ভেতর থেকেই বদলাতে হয়। এই বদলানোর কাজটা করে থাকে সংস্কৃতিচর্চা। সামনে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। বাঙালি ফেব্রুয়ারিকে ভালোবাসে তাই ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে সারা দেশে একটি সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা প্রয়োজন। এই জরুরি প্রয়োজনে সংস্কৃতি চিন্তাবিহীন রাজনীতিবিদদেরও অংশগ্রহণ করা উচিত।