কে ধরবে ভবিষ্যৎ কৃষির হাল

প্রকাশিত: ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৩, ২০২০

খাসখানি নামে এক দুর্দান্ত সুগন্ধি ধানের জন্মভূমি যশোর। বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন পদ্ধতির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এই ধানের আদি নাম বদলে নতুন নাম দিয়েছে ব্রিধান-৩৪। মণিরামপুর উপজেলার ঝাপা বাঁওড়ে একসময় বাসনা ছড়াত এই ধান। ঝাপা বাঁওড়ে এমন নানাজাতের ধান বুনতেন রাজগঞ্জের কৃষক আশ্রাফ আলীর পরিবার। আশ্রাফ আলীর পরিবার এই ধান ধরে রাখতে পারেননি। কেবল ধান নয়, ধরে রাখতে পারেননি নাতি মোর্তাজ আলীকেও। লাঙল-জোয়ালে কৃষিকাজ শেখালেও মোর্তাজকে ধরে রাখা যায়নি। চার বছর হলো চার লাখ টাকা খরচ করে ‘ভালো একটা ভবিষ্যতের জন্য’ সে পাড়ি জমিয়েছে মালয়েশিয়া। মোর্র্তাজের সঙ্গে আলাপ হয় মালয়েশিয়ার পেনাংয়ের থানজুম বোঙ্গার এক হোটেলের সামনে। কাজ করে এক চাইনিজ মালিকের অধীনে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে। মাসে বিশ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারে। বাইশ জন মিলে থাকে একটি ঘরে। এই ঘরে আলাপ হয় বাংলাদেশ থেকে আসা নানা অঞ্চলের তরুণ কৃষকদের সঙ্গে, আজ যাদের নিদারুণ পরিচয় ‘অভিবাসী শ্রমিক’। আমরা কুমতার এলাকার এক প্রবাসী বাঙালির দোকান থেকে প্যাকেটজাত চিনিগুঁড়া চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, মাংস কিনি। রান্নার পর খেতে খেতে জানা হয়, বাংলাদেশ থেকে আসা এই তরুণদের সবাই শৈশব থেকে মালয়েশিয়া আসার আগ পর্যন্ত কৃষিকাজে জড়িত ছিলেন। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশে কৃষির কোনো ‘ভবিষ্যৎ’ নেই, কৃষকের কোনো মানসম্মান নেই। হাড়পানি করা তাদের অভিবাসী জীবনের নানা যন্ত্রণা আর আহাজারির আলাপে পেনাং শহরে জমকালো রাত নামে। ফেরার পথে বারবার উঁকি দেয় এককালের গ্রামীণ কৃষক আর আজকের এই অভিবাসী শ্রমিকের প্রেরিত মুদ্রায় গড়ে উঠছে এক নতুন বাংলাদেশ। ভাবি খাসখানির কারিগরেরা একের পর এক এভাবে হারিয়ে গেলে ভবিষ্যতের এক ‘উন্নত’ বাংলাদেশ কোথায় পাবে সুগন্ধি ধানের সম্ভার?

মোর্তাজদের মতো কৃষক পরিচয় হারানো এমন আরও তরুণদের সঙ্গে আরেকদিন আলাপ হয় ঢাকার ধামরাইয়ের কালামপুরে। তারা সবাই এখানকার ইটভাটার শ্রমিক। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামে বাড়ি বশীর সানার। বশীর জানায়, ঘূর্ণিঝড় আইলার পর লবণাক্ততার কারণে এলাকায় কৃষিকাজ কঠিন হয়ে যায়। দলে দলে মানুষ ভিড় জমায় ইটের ভাটায়। বছরচুক্তিতে তারা বিক্রি হয়ে যায়। প্রতিদিন শীত মৌসুমে শ্যামনগর থেকে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৭টা পর্যন্ত প্রায় ৫২টি বাস ছাড়ে। এসব বাসে করেই দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের তরুণ কৃষকরা ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে দেশের নানান ইটের ভাটায়।

মোর্তাজ কি বশীরদের মতো এমন আরও তরুণ কৃষকের সঙ্গে দেখা হয় সিলেটের কোম্পানিগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায়। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পলাশ থেকে এসেছে লেফাজ মিয়া। মুমূর্ষু ধলাই নদীর তীরে বসে লেফাজ জানায়, প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলে জমি তলায়। গ্রাম থেকে গ্রাম হাওরের তরুণ কৃষকদের আজকের নিয়তি পাথর ও বারকি শ্রমিক। হাওরে এখন গেরস্থি করা খুব ‘দিগদারির’ বিষয়। দিগদারি মানে ঝামেলা। একদিকে আছে প্রাকৃতিক আপদ-বিপদ, অন্যদিকে কৃষি আবাদের খরচ বৃদ্ধি আবার অনিশ্চিত শস্যবাজার। মোর্তাজ, বশীর কি লেফাজের মতো আরেক গ্রামীণ তরুণের সঙ্গে দেখা হয় সাভার ইপিজেড এলাকায়। টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনের গ্রাম ক্যাজাই থেকে এসেছে শাপলা মৃ। শাপলা জানায়, শালবন কি বাইদজমিন সারা দিন কাজ করেও আজ সংসার চালানো কঠিন হচ্ছে। কৃষিকাজে এখন যুবকরা থাকতে চাচ্ছে না, এখানে কোনো আয় উন্নতি নাই। আদিবাসী ছেলেমেয়েরা এখন গার্মেন্টস, পার্লার, বাসাবাড়ি, নিরাপত্তা সার্ভিসসহ নানা কাজ করতে শহরে আসছে প্রতিদিন।

মোর্তাজ, বশীর, লেফাজ কি শাপলা বাংলাদেশের এই সময়ের তরুণ কৃষক প্রজন্ম। কিন্তু নিদারুণভাবে এরা কেউই কৃষিতে থাকতে পারছে না। জন্মমাটি ছেড়ে দেশ কি দেশের বাইরে তাদের অভিবাসন ঘটছে প্রতিদিন। চুরমার হয়ে পড়ছে পারিবারিক কৃষির ঐতিহাসিক ধারা। এভাবে দিনের পর দিন তরুণ প্রজন্ম কৃষি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকলে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কৃষির হাল ধরবে কে? কেমন হবে আগামীর কৃষিচেহারা? সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উন্নতি করছে। কিন্তু এই উন্নতি কেন দেশের তরুণ কৃষকদের স্বপ্নকে পাঠ করতে পারছে না? দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন চিন্তায় তরুণ কৃষকের জায়গা কোথায়? কাকে নিয়ে বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ কৃষির জমিন জীবন্ত রাখতে চাইছে? কৃষিপ্রধান এক দেশের এই প্রধান প্রশ্নকে এড়িয়ে কোনোভাবেই আমাদের জাতীয় উন্নয়ন কি বিকাশ অসম্ভব। আজ চারপাশ থেকে সবাই মিলে আমাদের এর উত্তর খোঁজা জরুরি। কেমন হবে ভবিষ্যতের কৃষি-আদল? কারা কীভাবে জাগ্রত রাখবে দেশের কৃষি-বুনিয়াদ? কীভাবে তরুণ কৃষিপ্রজন্মের সম্মান,

স্বীকৃতি এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র? এসব প্রশ্নের উত্তর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে জাতীয় কর্মকৌশল সবক্ষেত্রে প্রধান গুরুত্ব দিয়ে যুক্ত করতে হবে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে শতকরা ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। গ্রাম এলাকায় ৫৯.৮৪% এবং শহরের ১০.৮১% লোকের কৃষিখামার আছে। রাষ্ট্র এখনো কৃষিকে দেখে খাদ্য উৎপাদনের মূল খাত হিসেবে। সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার ‘ভিশন ২০২১’ গ্রহণ করে। তবে

কৃষি কেবলমাত্র এককভাবে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নয়; দেশের মানুষের আয় এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি প্রতিটি বাস্তুসংস্থানের অপরাপর জীবিত প্রাণসত্তার বেঁচে থাকাকে সহায়তা করে। ঐতিহাসিকভাবে পারিবারিক কৃষি ঐতিহ্য নিয়ে বিকশিত হলেও দিন দিন কৃষিতে পরিবারের সব সদস্যের সমান অংশগ্রহণ থাকছে না। বিশেষভাবে কৃষিতে যুবসমাজের অংশগ্রহণ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস, কৃষক পরিচয়ে সামাজিক মর্যাদা না পাওয়া, কর্মসংস্থানের অভাব, কৃষিপণ্যের অনিশ্চিত ন্যায্যবাজার, সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নানামুখী অভিবাসন এবং পরিবেশগত ও জলবায়ুজনিত ঝুঁকির কারণে গ্রামবাংলার এক বিশাল যুবসমাজ আজ কৃষি-পেশাকে ছেড়ে শহরমুখী নানাবিধ জীবিকা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের নানা জায়গায় কৃষিতে তৈরি হচ্ছে নিদারুণ শ্রমিক সংকট। সামগ্রিকভাবে এই পরিস্থিতি দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এবং ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় কৃষিনীতি তৈরি করে, কিন্তু এতে কৃষিতে যুবদের ভূমিকাকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। পরবর্তীকালে ২০১৮ সালের জাতীয় কৃষিনীতি প্রথমবারের মতো ‘কৃষিতে যুবশক্তি’ শিরোনামে একটি বিশেষ অধ্যায় (ধারা-১৪) যুক্ত করে। জাতীয় কৃষিনীতি (২০১৮) মনে করে, ‘একটি শিক্ষিত, সচেতন, জ্ঞানসমৃদ্ধ, দেশপ্রেমিক এবং উদ্যমী যুবশক্তি দ্বারা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কৃষি পরিচালিত হবে’। কৃষিতে যুবদের সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে জাতীয় কৃষিনীতি নিম্নরূপ কার্যক্রম গ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে:

১৪.১: ‘যুব কৃষক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কৃষিতে যুবদের সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা;

১৪.২: উচ্চ ফলনশীল এবং উচ্চমূল্য ফসল উৎপাদন এবং ছোট ও মাঝারি কৃষি শিল্প স্থাপনে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে যুবদের আত্ম-কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা;

১৪.৩: যুব কৃষকদের বিনিয়োগে উৎসাহ, সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে কৃষিকাজে অনুপ্রাণিত করা;

১৪.৪: প্রশিক্ষণ, সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যুবদের সফল

কৃষি/কৃষি শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা;

১৪.৫: কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কায়িক শ্রম হ্রাসপূর্বক শিক্ষিত যুবদের কৃষিতে আকৃষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করা;

১৪.৬: উৎপাদিত ফসলে মূল্য সংযোজন কৌশল/পদ্ধতি প্রয়োগ করে যুবদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা;

১৪.৭: কৃষি উপকরণ ব্যবসা, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন, মাছ চাষ, পশুপালন ইত্যাদি কৃষি সহযোগী কর্মকাণ্ডে যুবদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিস্ময়করভাবে জাতীয় কৃষিনীতির অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এখনো তরুণ

কৃষকদের নিয়ে কোনো বিশেষ রাষ্ট্রীয় কর্মকৌশল নেই। যুবসমাজ ক্রমশ কৃষিবিমুখ হয়ে পড়ছে। এমনকি তরুণরা কৃষিতে আরও বেশি যুক্ত হবে এমন কোনো প্রক্রিয়া বা প্রণোদনাও নেই। অথচ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ ভাগ তরুণ যুবসমাজ। এখনো বাংলাদেশের শহর-গ্রামে কৃষি, পরিবেশ ও বৈচিত্র্য সুরক্ষাসহ নানামুখী সামাজিক কাজের সঙ্গে যুবরাই নানাভাবে জড়িত। স্বপ্ন দেখি আগামী দিনের কৃষির নেতৃত্ব দেবে এই যুব তরুণরাই। জাতীয় কৃষিনীতিতে ব্যক্ত কৃষিতে যুবশক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি দেশের সব প্রান্তের গ্রাম-শহরের শিক্ষিত কি নিরক্ষর সব শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ যুব-তারুণ্যকে নানাভাবে দেশের সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই। এই দেশ আমাদের, এই দেশের মাটি-পানি-আবহাওয়া এই দেশের কৃষি আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের পরিচয়। কৃষিতে যুবশক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখার আহ্বান জানাই: কৃষিভিত্তিক এবং কৃষক যুব সংগঠন ও নেটওয়ার্ককে সহযোগিতা ও শক্তিশালী করতে হবে।

যুবদের জন্য কৃষিসংশ্লিষ্ট বিশেষ প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, ক্যাম্পেইন, মেলা, আয় ও দক্ষতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করতে হবে।কৃষিতে নারীর অবদানকে গুরুত্ব সহকারে স্বীকৃতি দিয়ে সব ক্ষেত্রে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিপ্রতিবেশ, সংস্কৃতি ও এলাকাভিত্তিক কৃষিচাহিদা গুরুত্ব দিয়ে সামগ্রিক যুব কৃষিকর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

যুবদের উৎসাহিত করতে সহজ ও বিনাশর্তে কৃষিঋণ, সৃজনশীল কৃষি উদ্যোগ, লোকায়ত কৃষিকৌশল ও দেশীয় বৈচিত্র্য সুরক্ষা, কৃষিভিত্তিক শিল্প এবং যুব কৃষি উদ্যোক্তা তৈরিতে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। কৃষি সংশ্লিষ্ট স্থানীয় থেকে জাতীয় সব পর্যায়ে কমিটি, নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুবদের যুক্ত করতে হবে।

প্রতিটি ইউনিয়নে যুবদের জন্য কৃষিভিত্তিক কর্মসংস্থান তৈরি করে কৃষি পেশার সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।




error: Content is protected !!