মেক্সিকোয় হত্যার ঘটনা রেকর্ড ছুঁয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ৯৫ জন বাসিন্দা প্রাণ হারাচ্ছে সহিংসতায়, প্রতি ১৫ মিনিটে একজন মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।
হত্যার ঘটনার পেছনে মাদক চক্রের লড়াই এবং তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কৌশলকেও দায়ী করা হয়। ইতিমধ্যে সহিংসতার বিরুদ্ধে শান্তির জন্য মিছিল নিয়ে একশো ত্রিশ কিলোমিটারের বেশি হেঁটেছেন অ্যাকটিভিস্টরা।
সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, ২০১৯ সালে দেশটিতে ৩৪ হাজার ৫৮২জনকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালের পর এটাই সর্বোচ্চ।
মেক্সিকোর এই তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে, ২০১৯ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ায় ১১ হাজার যোদ্ধা এবং বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস।
বিশ্বের অন্যতম হত্যাকাণ্ডের দেশ হিসেবে মেক্সিকোর পরিচিতি পাওয়ার পেছনে কুখ্যাত মাদক চক্রগুলোকে দায়ী করা হয়।
চলতি মাসের শুরুতে দশজন আদিবাসী সংগীতশিল্পীকে পশ্চিম মেক্সিকোতে অতর্কিতে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং তাদের দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। নিহতদের বয়স ১৫ থেকে ৪২ বছরের মধ্যে। গুয়েরেরে রাজ্যের চিলাপা শহরের একটি অনুষ্ঠান থেকে তারা ফিরছিলেন।
গত নভেম্বরে মেক্সিকো-আমেরিকান মরমন পরিবারের নয়জন সদস্যকে মাদক চক্রের বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করে, যাদের মধ্যে রয়েছে তিনজন নারী ও ছয়টি শিশু। এই ঘটনা দেশে-বিদেশে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করে।
ওই ঘটনার জের ধরে নামী দুইজন অ্যাকটিভিস্ট হাভিয়ের সিসিলিয়া ও জুলিয়ান লেব্যারন একটি মিছিলের আয়োজন করেন। মিছিলটি ২৩ জানুয়ারি মোরেলোস শহর থেকে শুরু হয়ে তিন দিন পরে রাজধানী মেক্সিকো সিটিতে গিয়ে শেষ হবে।
মাদক ব্যবসায়ীদের লড়াইয়ের ফলে ব্যাপক হত্যা এবং নিখোঁজের ঘটনাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এই মিছিল।
প্রায় ৬২ হাজার নিখোঁজ মানুষের ব্যাপারে অনুসন্ধান করার জন্য সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করেছে মেক্সিকো।
মেক্সিকো ন্যাশনাল সার্চ কমিশনের প্রধান কার্লা কুইনটিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা এখানে মানুষের জীবন ও পরিবার নিয়ে কথা বলছি। এসব তথ্যপ্রমাণ খুবই ভয়াবহ এবং এর পেছনে যেসব ঘটনা রয়েছে, তা পরিবারগুলোর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।”
বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব জুড়ে যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, তাতে মেক্সিকোর স্থান উনিশতম।
এই তালিকার শীর্ষে আছে এল সালভাদর- যেখানে ২০১৭ সালে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৬২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই পরিসংখ্যান অনেক কমে এসেছে।
সংকটপূর্ণ ভেনেজুয়েলায় ২০১৯ সালে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৬০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে ভেনেজুয়েলান অবজারভেটরি অফ ভায়োলেন্স নামের এনজিও।
নাইজেরিয়া থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান আংশিক হলেও, জাতিসংঘের হিসেবে ২০১৩-২০১৬ সালে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে দেশটিতে ৩৪ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তালিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা রয়েছে নবম অবস্থানে- সেই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা নারীদের ওপর সহিংসতার জন্য সবচেয়ে খারাপ দেশ।
ব্রাজিলের পরিস্থিতিও মেক্সিকোর চেয়ে খারাপ-২০১৮ সালে দেশটিতে ৫১ হাজার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে ব্রাজিলিয়ান ফোরাম অফ পাবলিক সিকিউরিটি। দেশটিতে প্রতি দশ মিনিটে একজন নিহত হচ্ছে।
মেক্সিকোয় পাবলিক সিকিউরিটি বিষয়ক সমন্বয় দপ্তরের প্রধান স্যামুয়েল গঞ্জালেজ রুইজ দেশটির হত্যাকাণ্ডের এসব ঘটনাকে স্থানীয় সমস্যা বলে বর্ণনা করছেন, জাতীয় সমস্যা নয়।
এসব পরিসংখ্যান বলছে যে, বেশির ভাগ সহিংসতার ঘটনা ঘটছে কিছু অপরাধ প্রবণ এলাকায়, যেখানে বিভিন্ন গ্যাং এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লড়াই করছে। বিপরীতভাবে, জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র ইয়ুকাটান এবং বাজা ক্যালিফোর্নিয়া সুরে সবচেয়ে কম সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
২০০৬ সালে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ফিলিপ ক্যালডেরন ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেন এবং প্রায় ৫০ হাজার সেনা ও নৌ সদস্য মোতায়েন করেন। পাশাপাশি ফেডারেল পুলিশ কর্মকর্তারাও কার্টেলগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।
তার ছয় বছরের শাসনামলে মাদক সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল ৬০ হাজার। অনেকে ধারণা করেন, এই সংখ্যা আরও বেশি হবে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়াল লোপেজ ওব্রাডর ‘শান্তি অর্জন এবং মাদকের যুদ্ধ অবসানের’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু মাদক যুদ্ধ ঠেকাতে একটি ন্যাশনাল গার্ড গঠনে তার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এর লক্ষ্য নির্দিষ্ট নয় এবং পূর্বসূরিদের নীতির থেকে খুব বেশি আলাদাও নয়।